গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের টাকার নেশা অনেক আগের। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার সময়েই ফুলতে শুরু করেন তিনি। টের পান টাকার কুমির হতে পারবেন প্রধান প্রকৌশলী হলে। তাই মোটা অঙ্কের টাকায় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে লবিস্ট নিয়োগ করেন তিনি। অন্তত ২৫ কোটি টাকা খরচ করে পদোন্নতি নেন কাঙ্ক্ষিত পদে।

২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পান রফিকুল। এরপর তিনি টাকা ছাড়া আর কিছুই চিনতেন না। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া, ঠিকাদারি কাজের কমিশন, বদলি, নিয়োগ- সবকিছুতেই টাকা দিয়ে খুশি করতে হতো তাকে। এভাবে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশে-বিদেশে তার বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ সহায়-সম্পত্তির ইয়ত্তা নেই। সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে আটক যুবলীগ নেতা জি কে শামীমও জিজ্ঞাসাবাদে এই রফিকুল ইসলামের নাম বলেছেন।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে শামীম জানিয়েছেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরে ঠিকাদারি কাজ করতে গিয়ে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাইকে দেড় হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে তাকে। বিষয়টি অবিশ্বাস্য হলেও অনেকে বলছেন, জি কে শামীমের স্বীকারোক্তি একেবারে উড়িয়ে যায় না। কারণ বর্তমানে জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে পাঁচ হাজার ২০৭ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ করছে। এমনকি যাদের হাতে তিনি আটক হয়েছেন, সেই র‌্যাবের হেড কোয়ার্টার নির্মাণের জন্য ৫৫০ কোটি টাকার কাজও করছে তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অবশ্য বালিশ কেলেঙ্কারির কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে অনেক দিন ধরেই জি কে শামীমের ফার্ম পূর্ত ভবনে ঠিকাদারি কাজ করে আসছে।

গা ঢাকা দিয়েছেন রফিকুল ও হাই: গতকাল রোববার সারা দিন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে রফিকুল ইসলাম সম্পর্কে বিস্ময়কর এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অবশ্য কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি নন। তারা বলছেন, রফিকুলের প্রধান সহযোগী ছিলেন সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাই। এ ছাড়া কয়েকজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীও তাদের সঙ্গে ছিলেন। রফিকুল ইসলাম সরাসরি ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন আদায় করতেন। পাশাপাশি সব নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকেও প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিতে হতো রফিককে। ঠিকাদারি কাজ দিতে তিনি আগে থেকেই তিন থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন। এর বাইরে অন্য প্রকৌশলীরা যে কমিশন পেতেন, তাদের থেকেও তাকে কমিশন দিতে হতো। দায়িত্ব ছাড়ার আগে একদিনে সবচেয়ে বেশি বদলির রেকর্ডও করে গেছেন রফিকুল ইসলাম। জি কে শামীম গ্রেফতারের পর থেকেই রফিকুল ইসলাম ও আব্দুল হাই গা ঢাকা দিয়েছেন। ফোনও বন্ধ রয়েছে তাদের। গণপূর্ত অধিদপ্তরের বর্তমান অন্য প্রকৌশলীরাও ভয়ে আছেন। অনেকে ফোন বন্ধ করে রেখেছেন, অনেকে অপরিচিত নম্বরের ফোন ধরছেন না। এমনকি গণপূর্ত অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটটিও তারা বন্ধ করে দিয়েছেন। যাতে কেউ কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর না পান।

ছাত্রশিবিরে যুক্ত ছিলেন রফিক: একজন প্রকৌশলী জানান, ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যুক্ত ছিলেন রফিক। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের দুঃসম্পর্কের ভাগ্নে হওয়ায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় সংসদ সচিবালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি। গোলাম আযমের সুপারিশে বিএনপি সরকারের গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে তিনি অধিদপ্তরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী ও কোরবানির ঈদে মির্জা আব্বাসসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গরু সরবরাহকারী হিসেবে গণপূর্ত অধিদপ্তরে তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে।

পূর্ত বিভাগের কর্মচারীরা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে রফিকুল ইসলামের গ্রামের বাড়িটি এক নামে রাজাকার বাড়ি হিসেবে সবাই চেনেন। জোট সরকারের আমলে নিজামীর বাসায় অবাধ যাতায়াত ছিল তার। সে সময় পদোন্নতিও পান। পরে রাতারাতি আওয়ামী লীগার বনে যান তিনি। যদিও একদিন নিজের দপ্তরেই বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদের নেতাদের লাঞ্ছিত করেন তার লোকজন দিয়ে। ছিঁড়ে ফেলেন দপ্তরে টানানো বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত ফেস্টুন-ব্যানার। এ ঘটনায় তার অপসারণ চেয়ে বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা পরিষদ ওই সময় কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সমাবেশও করে।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে ২০০ কোটি টাকার বাজেট: রফিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছিলেন লিংকন নামের একজন প্রকৌশলী। দ্বিতীয় দফায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার জন্য তিনি ২০০ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। অভিযোগ, এ সময় তিনি একজন মন্ত্রীকে ২০ কোটি ও আরেকজন সচিবকে ১০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তার কুকীর্তির খবর জানাজানি হয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তার চাকরির মেয়াদ বাড়াননি।

মানসিক যন্ত্রণায় মৃত্যু হয় আবুল হাশেমের: একজন প্রকৌশলী বলেন, রফিকুল ইসলাম প্রধান প্রকৌশলী থাকার সময় একজন সচিব ও তার স্ত্রীর জন্য বিদেশ থেকে কোটি টাকা দামের ডায়মন্ডের উপহার সামগ্রী এনে দিয়েছেন। আরেকজন প্রকৌশলী বলেন, কানাডায় অবস্থানরত ছেলের জন্য ডলার পাঠাতে সহযোগিতা না করায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের ই/এম সার্কেল-৩-এর (শেরেবাংলা নগর অঞ্চল) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাশেমকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছিলেন রফিকুল। সেই মানসিক যন্ত্রণায় আবুল হাশেমের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে আবুল হাশেমের স্ত্রী অভিযোগ দিতে চাইলে রফিকুল ইসলাম আবুল হাশেমের স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে স্বামীর পেনশনের টাকা না পাওয়ার হুমকি দেন। পরে তিনি আর এগোননি। কানাডাতেও রফিকুলের বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে।

রফিকের যত ফ্ল্যাট-বাড়ি, ব্যাংক ব্যালান্স: রফিকুল ইসলাম তার প্রথম স্ত্রীর ছেলে শাওনের মাধ্যমে হংকংয়ের এইচএসবিসি ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকা জমা রেখেছেন। এ ছাড়া তার নিজের নামেই ঢাকায় একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। ধানমণ্ডির ৮ নম্বর রোডের ৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গ্রিনরোডের গ্রিন কর্নার নামের অ্যাপার্টমেন্টে দুটি ফ্ল্যাট, গুলশানের ৩৫ নম্বর রোডের ৪৪ নম্বর বাড়িতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং বনানীর ৭ নম্বর রোডের এফ/১৭ নম্বর হোল্ডিংয়ে আনোয়ার মঞ্জিল নামে একটি বাড়ি রয়েছে তার। মিরপুরে ১০ কাঠা জমির ওপর ১২টি ফ্ল্যাটবিশিষ্ট আরেকটি ছয়তলা বাড়ির মালিকও তিনি।

অবসরের আগে বদলি-বাণিজ্য: প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব ছাড়ার আগে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপক হারে বদলি শুরু করেন রফিক। কয়েক মাস আগে থেকেই প্রতিদিন গড়ে পাঁচজনকে বদলি করতে থাকেন তিনি। মাত্র এক মাসেই বদলি করেন ১৫৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। যাদের মধ্যে উপসহকারী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে সহকারী প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীও রয়েছেন। এ সময় দেড় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করেন তিনি। অনেককে বদলি করার পর সেখান থেকে আবারও বদলি করেন অন্য স্থানে। এভাবে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেন তিনি। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ঢাকার বাইরের কর্মকর্তাদের বড় বড় প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন। আবার অনেককে বদলি করেন তাদের পছন্দ অনুযায়ী মন্ত্রীপাড়া, সংসদ, গণভবন, বঙ্গভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। এসব গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়ে পদ ফাঁকা করতে কর্মরতদের অন্যায়ভাবে সরিয়ে দেন অন্যখানে। প্রতিটি বদলিতে পাঁচ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন রফিক। এ ছাড়া ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে এবং বিএনপি-জামায়াত কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন করে কামিয়ে নেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।উৎস -সমকাল