গত ৩১ আগস্ট ভারতের আসাম রাজ্যের নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই তালিকায় জায়গা হয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ মানুষের। আর এ থেকে বাদ পড়েছেন ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ।

বিপুল সংখ্যক মানুষকে আসাম তথা ভারতের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়ায় উদ্বিগ্ন বিভিন্ন মহল। এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দৈনিক যুগশঙ্খ’।

বাংলাদেশের জাতীয় হিন্দু মহাজোট মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দচন্দ্র প্রামাণিক ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাসের সঙ্গে কথা বলে ‘এনআরসি-ছুট হিন্দুদের বাংলাদেশে ফেরাক দিল্লি’ শিরোনামে দৈনিক যুগশঙ্খের প্রথম পাতায় বিশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
শুক্রবার দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি তুলে দেওয়া হলো:-

দেশভাগের অভিশাপ সবচেয়ে বেশি বইতে হয়েছে বাঙালি হিন্দুকে। এমনকী স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পরও ফের রাষ্ট্রহীন হওয়ার আতঙ্কে তারা। বাঙালি হিন্দুকে নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতিও নতুন নয়। এবার বাংলাদেশের হিন্দু সংগঠনগুলোও কি ঢাকার ওপর চাপ সৃষ্টির চিরাচরিত রাজনীতি করতে আসামের সেই বাঙালি হিন্দুদেরই নতুন করে দাবার ঘুঁটি করতে চাইছে? বাংলাদেশের হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের স্বার্থে সোচ্চার সংগঠনগুলোর বক্তব্য থেকে এমন প্রশ্ন ওঠা অবান্তর নয় মোটেও।

নাগরিকপঞ্জি থেকে যেসব হিন্দু বাঙালির নাম বাদ পড়েছে, তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হোক। এমনটাই প্রস্তাব গোবিন্দচন্দ্র প্রামাণিকের। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিবের যুক্তি, এর ফলে তাঁদের দেশে হিন্দুর সংখ্যা বাড়বে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত আসামের এনআরসিকে ‘নিরপেক্ষ দলিল’বলে অভিহিত করে বলেন, যেসব হিন্দু বাঙালি রাষ্ট্রহীন হয়েছেন, আন্তর্জাতিক বিধি ও আইন মেনে তাদের স্থিতি ঠিক করা হোক। তবে, দিল্লির এটা বুঝে রাখা উচিত যে, পড়শি রাষ্ট্র বাংলাদেশ যদি সিরিয়ার মত মৌলবাদীদের আখড়া হয়ে ওঠে তাহলে এর আঁচ ভারতের ওপরও পড়বে।

বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে যুগশঙ্খের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গোবিন্দবাবু বলেন, এনআরসি থেকে যেসব বাঙালি হিন্দুর নাম বাদ পড়েছে, তাঁদের বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার সম্ভাবনাই প্রচুর। মুসলিম মৌলবাদীদের লাগাতার নির্যাতনের ও সরকারের নির্লিপ্তির জেরে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা পালাচ্ছেন, এটা নির্মম সত্য।

প্রশ্ন ওঠে, আসামে বাঙালি বিদ্বেষের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের হিন্দুরা আসামে পালিয়ে আসবেন কেন? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এড়িয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বাংলাদেশ শাখার সভাপতি গোবিন্দচন্দ্র বলেন, এ দেশের মধ্যবিত্ত হিন্দুরা কলকাতায় বাড়ি কিনে রাখেন। কুড়িগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লার হিন্দুরা আসামে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিদিন গড়ে ৬৩২ জন করে হিন্দু বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিচ্ছেন। এঁরা শখ করে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে আসেননি, এসেছেন মুসলিমদের নির্যাতনের শিকার হয়ে। সব নির্যাতন যে সবসময় শারীরিক হয়, তা-ও নয়, হিন্দুরা বাংলাদেশে নিরন্তর মানসিক নির্যাতনের শিকার। ফলে প্রব্রজনমুখি মানসিকতা রয়েছে তাঁদের মধ্যে। কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হয়ে পড়ছে। ‘বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি, আমি এ দেশ ছেড়ে যেতে চাই না। তাই এনআরসি-তে যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, তাঁদের যদি বাংলাদেশে পুনর্বাসন দেওয়া হয়, তাহলে আমাদেরও সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটবে।’

তিনি বলেন, অর্পিত সম্পত্তি আইন সম্পর্কিত বিভিন্ন মামলায় সরকার বারবার বলেছে যে অমুক অমুক হিন্দু ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং এই-এই তাঁদের জমি। এ সব যদিও ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান আমলের কথা। এখন এনআরসি থেকে যেসব মানুষের নাম বাদ গেছে তাঁরা ঠিক ঠিক বাংলাদেশের কিনা, সেটা দু’দেশের সরকার বসে ঠিক করুক। যদি তাঁরা বাংলাদেশের হন এবং এখানে তাঁদের পূর্বপুরুষরা জমি ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তবে সেসব কিছু বিবেচনা করে তাঁদের ফিরিয়ে আনা হোক বাংলাদেশে। ফেরত দেওয়া হোক তাঁদের জমি ও সম্পত্তি। বলেছেন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী। তাঁর স্পষ্ট কথা, এ ব্যাপারে দিল্লির উচিত ঢাকার ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে অর্পিত সম্পত্তি আইন বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি অবলুপ্ত হতে পারে।

গোবিন্দবাবু স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ভারতের উচিত বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানো, কিন্তু পরিতাপের বিষয়, তা হচ্ছে না। তাঁর ভাষায়, ‘দিল্লির বিজেপি সরকারও আমাদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল বা আন্তরীক নয়। মুখে বাংলাদেশের হিন্দুদের স্বার্থের কথা বললেও বাস্তবে দিল্লি ঢাকার ওপর কোনও ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে না।’

গোবিন্দবাবু বলেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের আইনসভায় হিন্দুদের জন্য সংরক্ষণ, একটি স্বতন্ত্র সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের দাবি জানিয়ে আসছেন। ভারতের উচিত ছিল এ ব্যাপারের বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, কিন্তু তারা তা করছে না।

গোবিন্দবাবু বলেন, বিজেপি সরকারের ওপর বাংলাদেশের হিন্দুদের অনেক আশা, কিন্তু তারা যদি নিজেদর ভোট বাড়ানোর স্বার্থে বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুদের আশ্রয় দেওয়ার করে বলে প্রলোভন দেন তাহলে আখেরে এ দেশের হিন্দুদের যেমন ক্ষতি তেমনি ভবিষ্যতে ভুগতে হবে ভারতকেও। বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি ইসলামি মৌলবাদের রাজনীতি করবে, এতে জঙ্গিবাদ বাড়বে এবং এর আঁচ পড়বে ভারতেও।

এদিকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিসটান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, এতে কোনও পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি। ‘যদি পক্ষপাতিত্ব করা হত, তা হলে মুসলিমরা অনেক বেশি সংখ্যায় বাদ পড়তেন। কিন্তু যে পরিস্থিতি অনুমান করা হচ্ছে, তাতে এটা মোটামুটি সব পক্ষই মেনে নিয়েছেন যে এনআরসি থেকে হিন্দু বাঙালিই বেশি বাদ পড়েছেন।’ এ মন্তব্য করে রানাবাবু বলেন, বাংলদেশ থেকে হিন্দুর সংখ্যা কমছে, এটা সবাই জানেন। দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের চার সাড়ে কোটি বাসিন্দার মধ্যে দেড় কোটি ছিলেন হিন্দু ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। গত সত্তর বছরেরও বেশি সময়ে বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮০ লক্ষ, কিন্তু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলিয়ে জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি ৮০ লক্ষ।

রানাবাবু বলেন, সিলেট এলাকার হিন্দুরা মূলত ত্রিপুরা ও আসামে গেছেন, বাংলাদেশের অন্য প্রান্তের হিন্দুরা পালিয়ে গেছেন পশ্চিমবঙ্গে। এমনকী চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকার উপজাতিরাও আশ্রয় নিয়েছেন মিজোরামে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যেই প্রমাণ, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলদেশের জন্মের পর থেকে প্রায় আট শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষ হারিয়ে গেছেন। তবে ব্যুরো আট মাস আগে এখন এমন তথ্যও দিয়েছে যে শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বা হিন্দু জনসংখ্যার হার ২.৩ শতাংশ বেড়েছে।

রানাবাবু স্বীকার করেন, হিন্দুদের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনা। ‘পাকিস্তান থেকে আমরা স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু এখনও পাকিস্তানি মানসিকতা থেকে বাংলদেশ স্বাধীন হতে পারেনি। যে-চেতনা থেকে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, তা দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই হারিয়ে গেছে। দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের যে মানসিকতা ছিল, এর এখনও পরিবর্তন হয়নি।’ এ মন্তব্য করে রানাবাবু বলেন, এই পরিস্থিতিতে দিল্লির সরকার বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে বাংলাদেশের হিন্দুদের অন্য ধরনের সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। এমন কোনও বিল আইনে পরিণত হলে বাংলাদেশের ‘নির্যাতিত হিন্দুদের মধ্যে ভারতের মত নিরাপদ দেশে পালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ একদিকে যেমন বাড়বে তেমনি এ দেশের মুসলিমদের মধ্যে হিন্দুদের সম্পত্তি জলের দরে কিনে বা বিনামূল্যে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বেড়ে যাবে। এর ফলে বাংলাদেশ পুরোপুরি হিন্দুশূন্য হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা তাঁর।

রানাবাবু বলেন, সিরিয়ার মত একটি ভয়ঙ্ক় দেশ হয়ে উঠবে ভারত। এমন একটি দেশ যদি পড়শি হয় তা হলে এর আঁচ ভারতের ওপরও অবধারিতভাবে পড়বে, দিল্লির সরকারের সেটা আগেভাগেই বুঝে নেওয়া উচিত।

এনআরসি-ছুট হিন্দুদের কি বাংলাদেশে ফিরে আসা উচিত? রানাবাবু বলেন, এটা পুরোপুরি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের এ ব্যপারে কোনও মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে এতগুলো মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে গেল, এঁরা কোনও বিচার পাবেন না? কেউ তো স্বেচ্ছায় নিজের দেশ থেকে পালিয়ে যাননি, তাদের পালাতে বাধ্য করা হয়েছিল। শরণার্থীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স্তরে বিধি-নিয়ম রয়েছে, ভারত অবশ্য সেটা পালন করবে, এই আশাও রয়েছে রানাবাবুর। বিডি প্রতিদিন ,যুগশঙ্ঘ