জাতীয় স্বদেশ | তারিখঃ আগস্ট ২১, ২০১৯ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 598 বার
২১ আগস্ট। এই তারিখটিই এখন আমার জীবনে এক দুর্বিষহ স্মৃতির নাম। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে প্রতিনিয়ত নানারকম ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়। তবে এমন কিছু আছে, যা যাপিত জীবনে বড় ধরনের অভিঘাত রেখে যায়। বোধের বালিয়াড়িতে সেই দাগ অমোচনীয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা আমার জীবনে তেমনই এক ঘটনা।
গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এর আগে পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে বোমা হামলা, সিপিবি’র জনসমাবেশে বোমার বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে রিপোর্ট করতে হয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় তখন যতটা না বিহ্বল হয়েছি, তার চেয়ে শতগুণ বেশি হতভম্ব হয়েছি সেদিন।
তখন আমি চ্যানেল আইতে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। সেদিন আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রসচিব ওমর ফারুকের ডাকা একটি জরুরি প্রেস কনফারেন্সে। বিকেল ৫ টায় ছিল তা। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে ওই প্রেস কনফারেন্স এগিয়ে আনা হয় সাড়ে তিনটায়। পরে নির্ধারিত সময়ে শুরু হয়নি। সাড়ে চারটার শুরু করেন। নারী ও শিশুপাচার বন্ধে বাংলাদেশের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ জানানোর জন্য ওই সংবাদ সম্মেলন। পদক্ষেপগুলো না নিলে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতো যুক্তরাষ্ট্র, এমন তথ্য জানিয়ে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন সচিব। সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্ন করার সুযোগও দেননি।
আমার সঙ্গে ছিলেন ক্যামেরাপারসন তুষার। সম্মেলন শেষে যখন স্বরাষ্ট্র ভবনের ফুটেজ নিচ্ছিলেন, তখনই বিকট শব্দ। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি আবার শব্দ। তুষার বললেন, ‘আজকে না আপার সমাবেশ’। মুহূর্তে আমার টনক নড়লো। আমি দ্রুত তুষারকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র ভবনে আবার উঠতে গেলাম। যদি ওপর থেকে কিছু ফুটেজ নিতে পারি। কিন্তু ততক্ষণে কলাপসিপল গেট লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমরা দেরি না করে দ্রুত সচিবালয় থেকে বের হয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে দৌড়াতে লাগলাম। তুষার ততক্ষণে ক্যামেরা রোল দিয়ে রেখেছেন। এ সময় আবার পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ। আমরা যখন জিরো পয়েন্টে, ওই সময় পরপর কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনলাম। আমরা তখন দাঁড়িয়ে গেলাম সেখানে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার জিপটিকে এ সময় দ্রুত সচিবালয়ের সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি, তুষার ওই গাড়ির দিকে ক্যামেরা তাক করে রেখেছেন।
জিরো পয়েন্ট থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের দিকে যেই যেতে চাইলাম, তখনই দেখলাম, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ক্যামেরাপারসন হাবিব ভাই (হাবিবুর রহমান) চিৎকার করে কাঁদছেন, ‘আপা নাই, আপা নাই, সব শেষ হইয়া গেলো, সব শেষ হইয়া গেলো’। তুষার সেই ছবিও ধারণ করলেন। ঠিক এই সময় জিপিও’র দিক থেকে টিয়ারশেল ছুড়তে ছুড়তে সামনে এগুচ্ছিল একদল পুলিশ। ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় সব অন্ধকার। আমার আবার দৌড়। এক দৌড়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সামনে।
সামনের দৃশ্য দেখে আমরা দু’জনই হতবিহ্বল। কোনও ক্যামেরাপারসন বা পরিচিত সাংবাদিক চোখে পড়লো না। চারদিকে শুধু মানুষের আর্তনাদ। পুরো রাজপথ যেন রক্তে সয়লাব। তুষার ছবি তুলতে লাগলেন। একটু এগিয়ে আওয়ামী লীগ অফিসে গেটের দিকে যাওয়ার পথেই দেখি চ্যানেল আইয়ের মাইক্রোফোন পড়ে আছে। সঙ্গে নোটবুক ও বলপেন। নোটবুকটি রক্তাক্ত। মুহূর্তেই থমকে গেলাম! সেদিন চ্যানেল আই থেকে এই সমাবেশ কভারেজের দায়িত্বে ছিলেন আশরাফুল আলম খোকন (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ-প্রেসসচিব)। তুষার তখন অন্য ফুটেজ নেওয়ার কাজে ব্যস্ত। আমি তাকে ডেকে আনলাম মাটিতে পড়া চ্যানেল আইয়ের মাইক্রোফোনের ছবি নেওয়ার জন্য। এ দৃশ্য দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি। বলতে লাগলেন, ‘খোকন ভাই নাই! ওনার বডি কই?’ আমার বুক ফেটে গেলেও সংযত থাকতে হলো। রিপোর্টারদের মানবিক বোধ হয়তো মরে যায় কখনও কখনও! তুষারকে বললাম, ফুটেজটা আগে নিন। উনাকে খুঁজতে হবে। তুষার যখন ফুটেজ নিচ্ছেন, তখন একজন ছুটে এসে বললেন, আইভি আপা পড়ে আছেন সামনে। আমি দৌড়ে গেলাম। আপা আমার পূর্ব-পরিচিত ছিলেন। দেখি একজন দু’হাত দিয়ে আপাকে তুলে বসানোর চেষ্টা করছেন। আপা কাতরাতে কাতরাতে শুধু বললেন, ‘তোমার ভাই কই? ভাইরে দেখছো?’ (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান) বলেই তার মাথা ঢলে পড়লো একদিকে। আমি তার নাকের কাছ হাত দিয়ে কোনও নিশ্বাসের ছোঁয়া পেলাম না। দ্রুত ছবি নিলেন তুষার। একটু এগোতেই দেখি রমনা ভবনের পাশে পড়ে আছেন আদা চাচা। পুরো শরীর রক্তেভেজা। আর একটু এগোতেই দেখি একসঙ্গে বেশ কয়েক জন নারী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ছিন্নভিন্ন পা। একজন চোখ খোলা আকাশের দিকে, কিন্তু পুরো শরীর নিথর। এ সময় পুলিশ একটি বড় পিকআপ ভ্যান এলো। ভ্যান থেকে দুই/তিন জন পুলিশ নামলো। সঙ্গে সাধারণ পোষাকে আরও কয়েকজন। নিথর দেহগুলো সমাবেশে নিয়ে আসা ব্যানারে তুলে সেগুলো পুলিশ ভ্যানে উঠানো হচ্ছে। আমি তুষারকে আমার পাশে না দেখে খুঁজতে থাকি। এগিয়ে দেখি, তিনি রমনা ভবনের গলিতে ঝুঁকে পড়ে কিসের যেন ফুটেজ নিচ্ছেন। আমি দেখি, একটি গ্রেনেড পড়ে আছে। ওকে ধমক দিয়ে সরে আসতে বলি। কারণ গ্রেনেডের পিন দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট। মানে সেটি তাজা গ্রেনেড ছিল। এবার আমার ভয় পাওয়ার পালা। এতক্ষণ তো ভেবেছি সাধারণ কোনও বোমা হামলা। কিন্তু গ্রেনেড দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তবে তা নিজের মধ্যেই রাখলাম। তুষারকে বললাম, পুলিশের গাড়িতে ওঠে ছবি নিতে। আমরা রমনার গলি থেকে চলে আসতেই দেখি ভ্যান চলে যাচ্ছে। এক দৌড়ে আমি আর তুষার ভ্যানে উঠতে গেলাম। আমার শঙ্কা ছিল লাশ গুম হতে পারে। তুষারকে দৌড়াতে দৌড়াতে তা জানানোয়, তিনি আগেই উঠে পড়লেন ভ্যানে। আমি উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পায়ে-হাতে বেশ ব্যথা পেলাম। পুলিশের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আমি দেখলাম তুষার চলন্ত ভ্যানেই ছবি তুলছেন। তার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। এ সময় দেখা হলো বেশ কয়েকজন সিনিয়র ফটোগ্রাফারের সঙ্গে। তাদের কাছে খোকনের কথা জিজ্ঞেস করতে জানালেন, মিল্কি তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। জেনে খুশি হলাম, খোকন বেঁচে আছেন।
এরই মধ্যে দেখা হলো, বিবিসি’র কাদির কল্লোল ভাইয়ের সঙ্গে। তাকে জানালাম, পুলিশ লাশ তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর। এই সময় হাঁপাতে হাঁপাতে দেখি তুষার হাজির। তিনি বললেন, গাড়ি নগর ভবনের সামনে দিয়ে চলে গেছে। পুলিশকে রিকোয়েস্ট করে গাড়ি থেকে নেমেছেন তিনি।
ঠিক তখনই দেখতে পাই, সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগ অফিস থেকে বের হচ্ছেন। শুধু গেঞ্জি গায়ে। তাতেও ছোপ ছোপ রক্ত। প্রতিক্রিয়া নিতে চাইলাম। কাদির কল্লোল ভাই এগিয়ে ইতস্তত করছিলেন। এ রকম অবস্থায় ঠিক হবে কিনা। আমি পূর্ব-পরিচয়ের সূত্র ধরে সাহস করে এগিয়ে গেলাম। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, কিভাবে তারা মানবঢাল তৈরি করে নেত্রীকে বাঁচিয়েছেন। ঘটনা কখন শুরু হয়েছে তা-ও বললেন। সেটাই ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে সেদিনের ঘটনার একমাত্র তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। তার ওই প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই জানা যায় নেত্রী বেঁচে আছেন। এই প্রতিক্রিয়া চলার সময়ই হঠাৎ একদল পুলিশ স্টেডিয়ামের ২য় গেইটের দিক থেকে দৌড়ে এসে লাঠিচার্জ শুরু করে। সাবেক মেয়রকে কর্মীরা আবার দ্রুত পার্টি আফিসের ভেতরে নিয়ে যায়। এ সময় আবার টিয়ারশেল ছুড়লে ওই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হই।
পরের গন্তব্য
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকা থেকে আমরা জিরো পয়েন্টের দিকে হাঁটতে থাকি। কারণ আমাদের সঙ্গে থাকা গাড়িটি ততক্ষণে অফিসে চলে গেছে। রাস্তায় কোনও যানবাহন ছিল না। অফিসে ফোন করে প্রধান বার্তা সম্পাদক আলমগীর ভাইকে (শাহ আলমগীর, বর্তমানে প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক) পুরো ঘটনা জানাই। তিনি ফোনেই আমাদের ধন্যবাদ দেন। অ্যাসাইনমেন্ট না থাকার পরও সংবাদ সংগ্রহ করায়। তার কাছেই জানতে পারি, সহকর্মী খোকন ঢাকা মেডিক্যালে। তখন তাকে সেখান থেকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মেডিক্যালে চিকিৎসার মতো বাস্তবতা নেই।
তিনি আমাদের ঢাকা মেডিক্যাল হয়ে আসার জন্য পরামর্শ দিলেন। আমরা হাঁটতে হাঁটতে যখন মৎস্য ভবনের সামনে, তখন রাস্তায় দেখা চিফ রিপোর্টার সন্তোষ দা’র সঙ্গে ( প্রয়াত সন্তোষ মণ্ডল)। তিনি বললেন, ‘আমাকে ক্যাসেট দাও। আর তোমাদের আমি মেডিক্যালে পৌঁছে দিয়ে আসি।’ তার মোটরসাইকেলে করে রওনা হলাম। আমরা যখন হাইকোর্টের সামনে, তখন আবার আলমগীর ভাইয়ের ফোন। আমাকে ক্যাসেটসহ দ্রুত অফিসে যেতে বললেন। আর সন্তোষ দা’কে যেতে বললেন হাসপাতালে। আমি তাই করলাম। অফিসে যাওয়ার পর বার্তা পরিচালক শাইখ ভাই (শাইখ সিরাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও চ্যানেল আইয়ের পরিচালক) জানতে চাইলেন, ঘটনার বর্ণনা। তখন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। দু’চারটি বাক্য বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। শাইখ ভাই আর আলমগীর ভাই আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। এডিটিং প্যানেলে গিয়ে ফুটেজ দেখে শাইখ ভাই আবার ডেকে পাঠালেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ওয়েল ডান ব্রাদার, তুমি ইতিহাসের অংশ হলে’। জিজ্ঞাসা করলেন, আমি লিখতে পারব কিনা। পরে আমার জবাব শোনার আগেই বললেন, তুমি মুখে বলবে ইনট্রো, অন্য কেউ লিখে নেবে। ইন্ট্রোর পর শুধু রাশ ফুটেজ প্রচারিত হবে পাঁচ মিনিট।
সন্ধ্যা সাতটায় চ্যানেল আইয়ের সংবাদে সেভাবেই প্রচারিত হয়। পরে জেনেছি চ্যানেল আই কাছ থেকে রয়টার্স ওই ফুটেজ কিনে বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচার করে।
আর রাত ন’টার সংবাদে আমার ভয়েস ওভারসহ পুরো সংবাদ গোছানোভাবে প্রচার করা হয়।
উপসংহারের পরিবর্তে
দীর্ঘ তের বছর পর ‘বিহাইন্ড দ্য স্ক্রিন’-এর কথা লিখলাম। তাও অনেক সংক্ষেপে। আমার এখনও বুক কাঁপে সেদিনের কথা মনে করে। চোখের জল আটকাতে পারি না। মনে পড়ে আইভি আপার ( আইভি রহমান) শেষ বাক্য। আদা চাচার নিথর দেহের কথা। স্বেচ্ছাসেবকলীগের সেন্টু ভাইয়ের মুখ। জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকর্মী মাহবুব ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল পানখাওয়া মুখ। কিন্তু পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নেই এভাবে, যে মানুষটিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল ঘাতকেরা, তার জীবন তো দ্রোহের এক প্রতিশব্দ। তিনি মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় এই বাংলায় জাতির জনকের হত্যার বিচারের উদ্যোগ নিয়েছেন। চেয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি। ফলে, জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ, মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয়।
নজরুল কবির
লেখক: প্ল্যানিং এডিটর, বাংলা ট্রিবিউন
Leave a Reply