জাতীয় স্বদেশ | তারিখঃ আগস্ট ১৭, ২০১৯ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 602 বার
রাজধানীর মিরপুর রূপনগর চলন্তিকা ঝিলপাড় বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রায় আড়াই হাজার বস্তিঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুনের লেলিহান শিখা পার্শ্ববর্তী একটি বহুতল ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ১০ জন আহত হয়েছে। ৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে নিহতের কোন খবর পাওয়া যায়নি। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনতে এক পর্যায়ে পানি সঙ্কট পড়লে ১১৫ জনের ফায়ার সার্ভিস কর্মীকে বেশ বেগ পেতে হয়। পরে তারা বহুতল ভবনের রিজার্ভ ট্যাঙ্কিতে পানির পাইপ লাগিয়ে মেশিনের সাহায্যে পানি অগ্নিকাণ্ডস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, বাতাসের তীব্রতায় আগুন নেভাতেও তাদের বেগ পেতে হয়। এমনকি অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণেই আগুন আরও তীব্র হয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটে মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের ঝিলপাড় বস্তিতে এই আগুনের সূত্রপাত হয়। এদিকে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের পাশিপাশি র্যাব, পুলিশ, ওয়াসার সদস্য এবং বস্তিবাসীরা এগিয়ে আসে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে। রাত প্রায় ১২টায় আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ফায়ার সার্ভিসের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পুরো আগুন নিয়ন্ত্রের জন্য পোড়া স্থলে কাজ শুরু করছে ফায়ার সার্ভিস। তবে নিহতের কোন খবর পাওয়া যায়নি বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্বরত কর্মকর্তা এরশাদ হোসেন জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার ৭টা ২২ মিনিটে রূপনগর থানার পেছনের রূপনগর ঝিল পাড় বস্তিতে অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। আগুনের ব্যাপকতা দেখে পরে তাদের সঙ্গে আরও ১৭টি ইউনিট যোগ দেয়। এই ২৪ ইউনিট টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনেন। শাহাদাত হোসেন নামে একজন বস্তিবাসী জানান, ঝিলপাড় বস্তিতে সাত নম্বর, আট নম্বর ও আরামবাগ নামে তিনটি লাগোয়া বসতি রয়েছে। সেখানে এক হাজারেরও বেশি পরিবারের বসবাস। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বস্তির মাঝামাঝি এলাকা থেকে আগুনের সূত্রপাত। আগুনে তার ঘরটিও পুড়ে গেছে। বস্তিতের বেশিরভাগ গার্মেন্টস শ্রমিকরা বসবাস করেন। ঈদের ছুটির দিনে বস্তির অনেক বাসিন্দা গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করায় অধিকাংশ ঘর তালাবদ্ধ ছিল। আগুনে সেসব ঘরের সব মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। সাহাবুদ্দিন নামে এক ব্যক্তি জানান, ঈদের কারণে বস্তির বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া ছিল না। সন্ধ্যার পর হঠাৎ বস্তিতে আগুন লাগে। ইতোমধ্যে বস্তির টং ঘর ও টিনশেড ঘর, কাঠ ঘর মিলে প্রায় সাত হাজার ঘর পুড়ে গেছে। তিনি জানান, বস্তি ঘেঁষেই অনেকগুলো বহুতলা ভবন রয়েছে। কাছেই রূপনগর থানা। একটি দোতালা ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ভেতরে কেউ আটকা পড়েছে কিনা। তা এখনও কেউ নিশ্চিত হতে পারেননি। হাসান নামে একজন বস্তির বাসিন্দা জানান, বস্তির পশ্চিম পাশেই আমার বাসা। আমি আগুন-আগুন চিৎকার শুনে বাইরে বের হই। আমি চেষ্টা করেছি আগুন নেভাতে। কিন্তু পারিনি। এমন আগুন আমি জীবনেও দেখিনি। ঘর থেকে কিছু বের করতে পারিনি। বস্তিবাসীরা জানান, চলন্তিকা ঝিলপাড় বস্তিতে সাত হাজার পরিবারের ২০ হাজার সদস্যের বাসবাস ছিল। আগুনে সব ঘর পুড়ে গেছে। কেউ আটকা পড়েছে কি না তাও জানা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বস্তিতে আগুন নেভাতে পানি সরবরাহে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। পরে বহুতল ভবনের রিজার্ভ ট্যাঙ্কিতে পানির পাইপ লাগিয়ে মেশিনের সাহায্যে পানি অগ্নিকাণ্ডস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করে ফায়ার কর্মীরা। আগুন লাগার পর চলন্ত মোড়ের সবকটি রাস্তায় সাধারণ যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। বস্তিতে লাগা আগুন পর তীব্র বাতাসের কারণে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে হতাহতের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ঘটনার পর ওই এলাকার বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এদিকে আগুন লাগার পর অনেকে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে নিজ ও ছেলে-মেয়ে রক্ষা করেন। মেহেদী নামে এক কিশোর জানান, সন্ধ্যার দিকে যুবলীগের ক্লাবঘরে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ নাকে আসে পোড়া গন্ধ। কিছুক্ষণ পর আগুন ও ধোঁয়া বেড়ে যায়। যেভাবে পারছি ক্লাব থেকে বের হয়ে আগুন নিভানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আগুন না নিভে বরং বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে ৯৯৯-এ ফোন করে আগুনের খবর জানাই। এরপর ফায়ার সার্ভিস আসে। ওই কিশোর জানায়, মা হাজেরা বিবিকে নিয়ে শুধুমাত্র পিএসপির সার্টিফিকেট ও কিছু জামা-কাপড় নিয়ে বের হতে পেরেছে। কিশোর মেহেদির বাবা শেখ ফরিদ পেশায় একজন সবজি ব্যবসায়ী। মেহেদির মা বিলাপ করে জানান, আমার সব শেষ হয়ে গেল। দীর্ঘদিনের জমানো টাকা, সাজানো সংসার ছারখার হয়ে গেল। এখন রাস্তায় আমার ঠাঁই হলো। হাজেরা নামে এই মহিলা জানান, আর কিছুক্ষণ দেরি হলে হয়তো মারাই যেতাম। সুমনা বেগম নামে এক মহিলা টিভি ঘাড়ে করে বেরিয়ে আসেন বস্তি থেকে। এ সময় তিনি আহাজারি করে বলতে থাকে, আল্লাহ গো, গরিবের ঘরেই কেন বারবার আগুন লাগে। দয়া করো। বাঁচাও। আমার বাচ্চার খোঁজ এখনও পাই নাই। শুভ নামে ৭ বছরের ছেলের সঙ্গে দেখা হয়নি মা সুমনা বেগমের। এদিকে আগুন থেকে বাঁচতে দুই মেয়ে মরিয়ন ও সামিয়াকে নিয়ে বাইরে বের আসেন সাথী আক্তার। তার স্বামী সোহাগকে খুঁজে পাচ্ছেন না। তার স্বামীর ভাঙ্গাড়ির ব্যবসা করেন। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার স্বামী সোহাগ আমাদের বের করে দিলেও এখন তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। জানি না সে কোথায় আছে। আমাদের সব শেষ। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। সাথীর পাশেই সাইদুর রহমান নামে একজন একটি টিভি নিয়ে বসে কাঁদছেন। সাইদুর নামে ওই যুবক জানান, পেশায় তিনি রিক্সাচালক। সাইদুর রহমানও টিভিটি ছাড়া আর কিছুই বের করতে পারেননি। তিনি জানান, আমার ঘরে ফ্রিজ, কাপড় চোপড় কিছুই আনতে পারিনি। শুধু টিভিটা কাঁধে নিয়ে বের হয়েছি। আমার রিক্সাটিও আনতে পারিনি। সেটিও পুড়ে গেছে। রিক্সাচালক সাইদুর জানান, এখানে চাচাত ভাই মিলে ১০ জন থাকি। সবারই একি অবস্থা। কেউ কিছু নিয়ে বের হতে পারেনি। আমরা গরিব মানুষ। জানি না এখন আমাদের কোথায় ঠাঁই হবে।
Leave a Reply