মনে আছে আরমানের কথা! আরমান ছিল ‘খুনি’ মিতুর ভাই, যার জন্য তোলা ৮০ লক্ষ টাকার সিংহভাগ মিতুর বাবা মিতুর নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে মেরে দিয়েছিল। ২০১০ সালে লিউকোমিয়া আক্রান্ত একটি শিশু আরমান যে ছিল আকাশ ভাইকে ‘হত্যাকারী’ মিতুর ভাই।

হঠাৎ একদিন আমার কাছে চট্টগ্রাম থেকে ফোন আসে আমাদের এক ব্যাচম্যাটের ভাই অসুস্থ। তাকে বাঁচানোর জন্য ৮০ লক্ষ টাকা দরকার। আমার বন্ধু মেহেদী, নাকিব ও সাদ এর প্যারাতে আমি চট্টগ্রাম আসার সিদ্ধান্ত নিই। চট্টগ্রামে এসে বন্ধু-বান্ধব এবং ছোটভাই’রা মিলে বৈঠকে বসলাম; সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা এক মাসের মধ্যে ৮০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করবো। আরমানকে বাঁচাবো।

২০১০ সালের এপ্রিল মাসে কাজ শুরু করলাম আমরা। দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরমানের জন্য টাকা সংগ্রহ করা শুরু হয়েছিল। এইভাবে খেয়ে না খেয়ে রাতদিন পরিশ্রম করে টাকা তুলতো সারাদেশের হাজারো ছেলে-মেয়ে, যাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু আরমানকে বাঁচানো, ফুটফুটে একটি শিশুর মুখে হাসি ফুটানো। আমি নিজে আমার ভার্সিটি জীবনের ক্লাস পড়া বাদ দিয়ে সারাদিন মত্ত হয়ে থাকতাম কতটাকা কালেক্ট হলো, কতটাকা ব্যাংকে জমা পড়লো, আরো কত টাকা তুলতে হবে, তা হিসেব করতে। আবার সেগুলো আরমানের জন্য খোলা ফেইসবুক গ্রুপে আপডেট দেয়া লাগতো। কিন্তু তখনো আমরা জানতাম না যে, আমরা কিছু নিচু মানসিকতার মানুষের জালে আটকা পড়েছি।
মিতুর বাবা-মার অঢেল সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা আরমানের জন্য একটা টাকাও খরচ করেনি, কারণ তারা জানতো আরমান মারা যাবে। তাই তারা স্বামী-স্ত্রী ফন্দি করে মাঠে টাকা তোলার জন্য নামিয়ে দিয়েছিল তাদের মেয়েদের। মিতুর বাবার চট্টগ্রাম শহরে তৎকালীন সময়ে পাচঁলাইশ এরিয়াতে একটা ফ্ল্যাট বাসা ছিল, যার দাম ছিলো ৪০ লক্ষ টাকার উপরে, একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন ছিল, চট্টগ্রাম শহরে দোকান ছিল, জমি ছিলো। কিন্তু সেসব তথ্য আমরা আরমানের জন্য টাকা তোলার সময় জানতেও পারিনি।

সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ৮০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে আরমানকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর কিছুদিন পর আরমান মারা যায়।

আরমানের দাফনের পরে সত্য বের হয়ে আসতে শুরু করে। জানতে পারি মিতুর বাবার সম্পত্তির কথা। সবাই তখন আমাকে এবং আমার বন্ধুদের বলে ওর বাবার টাকা ছিল তারপরেও কেন আমরা টাকা তুললাম, আমরা জানালাম আমরা এসব জানতাম না।

তার কিছুদিন পরে মিতুর বাসায় ওর বাবার সাথে বসতে গেলাম, কারণ আমাদের হিসাব মতে ৮০ লক্ষ টাকা থেকে প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা বেঁচে যাওয়ার কথা। কিন্তু মিতুর বাবার সাথে বসতে গেলে তিনি জানান, মাত্র ১২ লক্ষ টাকা অবশিষ্ট আছে, সেইটা জেনে আমি আমার বন্ধু মেহেদী, সাদ, বিশু, রুমু সবাই খুবই অবাক হলাম। আমরা অনেক বিতর্ক করলাম, কিন্তু মিতুর বাবা আমাদের বলে ১২ লক্ষ টাকাই আছে। তখন আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম এই ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে আরমানের নামে একটা ট্রাস্ট করবো এবং আমরা লিকোমিয়া আক্রান্ত রোগীদেরকে এই ট্রাস্টের মাধ্যমে সাহায্য করবো। সবাই একমত হয়ে মিতুর বাবা-মা’কে জানিয়ে আসলাম, আমরা পরের মাসে ট্রাস্টের কাজ শুরু করবো। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় আমরা দেখা করে যাওয়ার ৩-৪ দিন পরে জানতে পারি মিতুর বাবা মিতুর নামে ওই টাকাটা ফিক্সড ডিপোজিট করে ফেলেছে। এটা শুনে আমরা সবাই হতবাক হয়ে গেলাম এবং মনের কষ্টে সিদ্ধান্ত নিলাম আর কখনো কারো সেবা করবো না।

তখন আরমানের জন্য খোলা গ্রুপটাতে, মানে ২০১০ সালে একটা ফেইসবুক গ্রুপে প্রায় ২০ হাজার মেম্বার ছিল। আরমান মারা যাওয়ার পরে আমাদের যারা এডমিন ছিল, তাদেরকে বাদ দিয়ে তারা আস্তে আস্তে গ্রুপটি বন্ধ করে দেয়।

আমরা দেশ-বিদেশে যারা আরমানের জন্য টাকা সংগ্রহের কাজ করছিলাম, তাঁরা শুধুমাত্র একটি ফুটফুটে হাসিখুশি শিশুর মুখে হাসি ফিরিয়ে দিতেই কাজ করছিলাম। কিন্তু আড়ালে এক ভয়ংকর ক্রিমিনাল তার ছেলের মৃত্যুর বিনিময়ে জাল বিস্তার করেছিল, যাতে সে তার ব্যবসার লোকসান এখান থেকে সামাল দিতে পারে।

আমরা তখন হার মেনে ছিলাম, কারণ তখন আমরা ছোট ছিলাম, বুঝতাম কম, আবেগ ছিল বেশী। কিন্তু এইবার কথা দিলাম আনিস সাহেব! ভাই হত্যার বদলা নিয়েই ছাড়বো।

(ফেসুবক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: সাবেক বিজ্ঞান বিষয়ক উপ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সূত্র- বিডি প্রতিদিন