অর্থনীতি | তারিখঃ ডিসেম্বর ৩১, ২০১৮ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 745 বার
ভারতে অর্থনৈতিক অঙ্গনের ২০১৮ সালের গরম খবর— ফ্লিপকার্টে ওয়ালমার্ট ৭৭ শতাংশ শেয়ারের বিনিময়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। অর্থাৎ কোম্পানির মূল্যায়ন ধরা হয়েছে ২১ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে বর্তমান মালিক যেমন সফট ব্যাংক, এক্সেল পার্টনার্স, ই-বে, নাস্পার্সসহ ৪৪ জন মালিকের কাছ থেকে শেয়ার কিনে নেন আর ২ বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। এত মূল্যবান একটা কোম্পানি, না-জানি কত লাভ করছে! অবাক কাণ্ড, কোম্পানি এখনো লাভের মুখ দেখেনি! ২০১৭-১৮ সালে ফ্লিপকার্টের লোকসান ১ হাজার ১৬০ কোটি রুপি, যা আগের বছর ছিল ১ হাজার ৬৪০ কোটি রুপি। ২০১৭-১৮ সালে ফ্লিপকার্টের আয় ২ হাজার ৭৯০ কোটি রুপি, যা আগের বছর ছিল ১ হাজার ৮৮২ কোটি রুপি। জিএমভি গ্রস মার্সেন্ডাইজ ভ্যালু ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ফ্লিপকার্ট একটা ই-কমার্স প্লাটফর্ম। তার মাধ্যমে বিক্রেতা পণ্য বিক্রয় করে। যত টাকার পণ্য বিক্রয় হয়, তাকে গ্রস মার্সেন্ডাইজ ভ্যালু বলে। ফ্লিপকার্ট এসব পণ্য কেনে না। সুতরাং গ্রস মার্সেন্ডাইজ ভ্যালু মানে ফ্লিপকার্টের বিক্রয় নয়। ফ্লিপকার্টের আয় হলো সেই বিক্রয়ের ওপর কমিশন। সচল ব্যবহারকারী ৫৪ কোটি, গত বছর ২৬ দশমিক ১ কোটি পণ্য বিক্রয় হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাফল্য বিচারের প্রচলিত মাপকাঠি বিক্রয়, লাভ ইত্যাদির পরিবর্তে নতুন মাপকাঠি যেমন পেজ রিভিউ, আইবল কন্ট্যাক্ট, আদেশ সংখ্যা ইত্যাদি চালু হয়েছে।
ডিসেম্বর, ২০১৬ সালে পাঁচটি বাইক নিয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে কুরিয়ার সেবাদানকারী স্টার্টআপ পাঠাও অক্টোবরে ২০১৮-তে প্রায় প্রতি মাসে ১০ লক্ষাধিক রাইডসেবা দিচ্ছে (ফিউচার স্টার্টআপ জুন ১০, ২০১৮)। কর্মী সংখ্যা ৫০০-এর অধিক। রাইডসেবা দিচ্ছে বাইকের পাশাপাশি মোটরগাড়িতেও। ফুড ডেলিভারি করছে। ঢাকায় চারটি, চট্টগ্রামে একটি বড় অফিস ও সিলেটে একটি অফিস আছে। তারা ১০ মিলিয়ন ডলার বা ৮০ কোটি টাকার বিনিয়োগ পেয়েছে (ডেইলি স্টার, এপ্রিল ৩০, ২০১৮)। কোম্পানি মূল্যায়ন ধরা হয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডলার বা ৮০০ কোটি টাকা। পাঠাও এখনো লাভের মুখ দেখেনি। এমন একটা কোম্পানির মূল্য ৮০০ কোটি টাকা, খুব আশ্চর্য নয় কি? ইট-কাঠের একটি কোম্পানির মূল্য ৮০০ কোটি হতে কত বছর লাগে?
২০০০ সালে সদ্য ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করা ফাহিম মাসরুর নিজের বাবার বাসায় ড্রইংরুমে কয়েকটি কম্পিউটার ধার করে শুরু করেন বিডিজবস। ২০১২ সালে তার ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রয় করেছেন অস্ট্রেলিয়ার একই ধরনের কোম্পানি সিকের কাছে ৩৮ দশমিক ৫ কোটি টাকায় (ফিউচার স্টার্টআপ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১২)। কোম্পানির মূল্যায়ন করা হয়েছিল প্রায় ১৫৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের মার্চে সিক আরো ১০ শতাংশ শেয়ার কিনেছে। কোম্পানির মূল্যায়ন বেড়ে হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা দাম বেড়েছে। কোম্পানির রিটার্ন অন ইকুইটি, আর্নিং পার শেয়ারের সঙ্গে এ মূল্যায়ন কি সঙ্গতিপূর্ণ?
টেকক্রাঞ্চে অলিভার ব্রাশটন লিখেছেন স্টার্টআপের জন্য ১০টি সাফল্যের মাপকাঠির কথা। গ্রাহক সংগ্রহ ব্যয় (কাস্টমার একুইজিশন কস্ট), গ্রাহক ধরে রাখার ব্যয় (কাস্টমার রিটেনশন কস্ট), গ্রাহকের আজীবন মূল্য (লাইফটাইম ভ্যালু অব কাস্টমার), ওভারহেড খরচ, মাসিক দহন (বার্ন) রেট, সচলতা বা রানওয়ে, লাভের হার, রূপান্তরের (কনভার্সন) হার, গ্রস মার্চেন্ডাইজ ভ্যালু, মাসিক সচল ব্যবহারকারী। তাই প্রচলিত মাপকাঠি, যেমন গ্রস লাভ, নিট লাভ, রিটার্ন অন ইকুইটি, রিটার্ন অন অ্যাসেট, ইবিটা ইত্যাদি দিয়ে যারা বিচার করবেন, তারা ধন্ধে পড়ে যাবেন। কারণ অনেক ক্ষেত্রে উচ্চমূল্যায়নের এসব স্টার্টআপের লাভ বলে কিছু নেই, বরং লোকসান গুনে যাচ্ছে। লরা টাইসনের মতে, স্টার্টআপের জন্য পাঁচটি মাপকাঠি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন— দহন হার (বার্নিং রেট), গ্রাহক হারনোর হার (চার্ন রেট), কার্যকারিতার (অ্যাক্টিভেশন) হার, দৈনিক বনাম মাসিক সচল ব্যবহারকারীর হার, আয়ের প্রবৃদ্ধি।
গ্রাহক সংগ্রহ ব্যয়: একটি নির্দিষ্ট সময়ে নতুন একজন গ্রাহক সগ্রহের জন্য বিপণন, বিক্রয়, বিজ্ঞাপন বাবদ যে খরচ হয়, সেটাকে ওই সময়ে যে গ্রাহক সংগ্রহ হয়েছে, তা দিয়ে ভাগ দিয়ে এ মাপকাঠি পাওয়া যায়। এটি বিপণন বিভাগের কার্যকারিতা প্রকাশ করে। প্রতিযোগীর গ্রাহক সংগ্রহ ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করলে প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বোঝা যায়। গ্রাহকের লাইফ টাইম ভ্যালুর সঙ্গে তুলনা করলেও বোঝা যায় কতটুকু ব্যয় করা যুক্তিযুক্ত।
বার্ন রেট: প্রতি মাসে নগদ নিট প্রদানকে বার্ন রেট বলে। অর্থাৎ যত টাকা আদান হয়, তার থেকে নগদ মোট প্রদান বাদ দিলে এ হিসাব পাওয়া যায়। স্টার্টআপদের সাধারণত ব্রেক ইভেনে আসতে অনেক সময় লাগে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা এঞ্জেল ইনভেস্টরের অর্থায়নে তারা চলে। প্রতি মাসে কত টাকা পোড়াচ্ছে তা জানা জরুরি।
রানওয়ে: স্টার্টআপের হাতে কয় মাসের চলার মতো অর্থ আছে তা বোঝায়। রানওয়ে মাস হিসেবে গণনা করা হয়। স্টার্টআপের হাতে যে অর্থ আছে, তাকে বার্ন রেট দিয়ে ভাগ করলে রানওয়ে পাওয়া যায়। রানওয়ে কমপক্ষে ১২ মাস হওয়া উচিত। ১৮ মাস হলে আরো ভালো। ১২ মাসের কম হলে উদ্যোক্তাকে আবার অর্থ সংগ্রহে নামতে হবে। স্টার্টআপের দৈনন্দিন কার্যক্রমে তাতে ব্যাঘাত ঘটে। কারণ স্টার্টআপ সাধারণত ওয়ান ম্যান আর্মি বা এক ব্যক্তির সেনাবাহিনী। সুতরাং উদ্যোক্তা অর্থ সংগ্রহ করতে নামলে নৈমিত্তিক কাজ আটকে যায়, আবার নৈমিত্তিক কাজে মনোযোগ দিলে অর্থ সংগ্রহ সম্ভব হয় না।
গ্রস মার্চেন্ডাইজ ভ্যালু: কিছু ব্যবসার ক্ষেত্রে রেভিনিউ বা আয় পুরো চিত্র প্রকাশ করে না। প্লাটফর্ম বা মার্কেট প্লেসের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। যেমন— উবার বা পাঠাও যে আয় পায়, সেটা পুরো সেবা বা বিক্রয়মূল্যের একটা ভগ্নাংশ মাত্র। গ্রস মার্চেন্ডাইজ ভ্যালুর মাধ্যমে প্রদানকৃত সেবা বা পণ্যের পুরো মূল্য জানা যায়।
মাসিক সচল ব্যবহারকারী: অ্যাপ, গেম বা সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের জন্য এটি উপযুক্ত। এর সঙ্গে আয়ের একটি সম্পর্ক আছে। একজন ব্যবহারকারীকে একবার ধরে একটি মাসে কতজন ব্যবহার করেছে, তা থেকে এ হিসাব বের করা হয়।
রূপান্তরের হার: ব্যবহারকারীদের মধ্যে কতজন ক্রেতায় পরিণত হয়েছে, তা দিয়ে এ হার বের করা হয়। এ হার যত বেশি হয় স্টার্টআপের জন্য তত ভালো।
গ্রাহক ধরে রাখার হার: অনেক সময় দেখা যায়, অনেক নতুন গ্রাহক সংগৃহীত হচ্ছে, কিন্তু বিক্রি সে হারে বাড়ছে না। কারণ পুরনো গ্রাহক থাকছেন না। স্টার্টআপের গ্রাহক সংগ্রহ ব্যয় একটি বড় খরচ। তাই পুরনো গ্রাহক ধরে রাখা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুন গ্রাহক সংগ্রহের চেয়ে সাশ্রয়ী। তাছাড়া গ্রাহক ধরে রাখতে না পারা মানে প্রদানকৃত সেবায় কোনো ঘাটতি আছে। তলায় ফুটো রেখে উপরে কল ছেড়ে দিয়ে সহজে চৌবাচ্চা ভরানো যাবে না।
লাভের হার বা অবদানের ফারাক (কন্ট্রিবিউশন মার্জিন): দিন শেষে ব্যবসা লাভের জন্য করা হয়। স্টার্টআপে লাভ বা ব্রেক ইভেনে আসতে সময় লাগে। কারণ স্টার্টআপে লাভের চেয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণে বেশি জোর দেয়া হয়। এর একটি কারণ দ্রুত বাজার দখল করা। স্টার্টআপরা উদ্ভাবনী। কিন্তু সহসাই তাদের অনুকরণে অন্যরা একই ব্যবসা শুরু করে। লাভ তাই কমে যায়। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ‘বিজয়ীর দখলে সব’ নীতি প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে লাভের বা ব্রেক ইভেনের দিকে না তাকিয়ে বাজার দখলের দিকে মনোযোগ দেয়া হয়। কিন্তু কোনো পণ্য বা সেবায় গ্রস লাভ না থাকলে সেই পণ্য বিক্রয় করা অর্থহীন। তাই কৌশল যা-ই হোক, গ্রস লাভের দিকে নজর দেয়া আবশ্যক।
প্রচলিত মাপকাঠি দিয়ে স্টার্টআপকে বিচার করা যায় না। তার মানে এই নয়, স্টার্টআপকে পর্যবেক্ষণ করা যাবে না। তাদের জন্য আলাদা মাপকাঠি আছে। অর্থায়নের আগে অথবা পরে সেই সব মাপকাঠি দিয়ে তার অবস্থা বা অগ্রগতি বিচার করা যুক্তিযুক্ত।-সূত্র -বনিকবার্তা
Leave a Reply