জেলা সংবাদ | তারিখঃ আগস্ট ২৩, ২০১৮ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 522 বার
একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে নানা কৌশলে মানব পাচার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সেই সঙ্গে সাগরপথে পাচার করা মানুষকে পরে জিম্মি করে ঢাকায় বসে তাদের স্বজনের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে আসছিল এই চক্র। মানব পাচারে তাদের মূল রুট ছিল কক্সবাজার থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। দীর্ঘ তদন্তের পর ধরা পড়ে চক্রের হোতা মোহাম্মদ আছেম। রাজধানীর কারওয়ানবাজার থেকে তাকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এরই মধ্যে বেরিয়ে আসে নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে আছেম ও তার সহযোগীদের ১০ কোটি টাকা রয়েছে। যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে উপার্জিত এই অর্থ রয়েছে, তা জব্দ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে সিআইডি। তবে সিআইডি বলছে, এই চক্রটি প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে নিরীহ মানুষদের পাচার করে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে মানব পাচার করে আসছিল চক্রটি। আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো- এই চক্রের মাস্টার মাইন্ড আছেম তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল জানান, আছেমের বাবা আনোয়ার হোসেন ও ভাই মোহাম্মদ খোবায়েদ মালয়েশিয়ায় ছিল। বাবা ও ভাই দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া থাকার সুবাদে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী গ্রুপের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। আছেম ২০১০ সালে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আছেম ও তার ছোট ভাই জাভেদ মোস্তফা মানব পাচারের জন্য প্রথমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দালাল নিয়োগ করে। সারাদেশে তাদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। মালয়েশিয়ায় ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি দালালের মাধ্যমে প্রথমে লোকজন সংগ্রহ করে। এরপর চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে এসব নিরীহ মানুষকে টেকনাফে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ট্রলারে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়। সেখানকার জঙ্গলে জিম্মি করা হয় তাদের। প্রাণে মারার ভয় দেখিয়ে তাদের বাবা-মা ও স্বজনদের কাছে ফোন করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এরপর পাচার হওয়া লোকজনের পরিবারের সদস্যরা মুক্তিপণের টাকা আছেম ও তার সহযোগীদের কাছে নগদে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করে। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হলে থাইল্যান্ডের জঙ্গলেই মেরে ফেলা হয় তাদের।
সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, আছেম ও তার ছোট ভাই জাভেদ, মা খতিজা বেগম ও তাদের সহযোগী আরিফ, একরাম, ওসমান সারোয়ার ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং টেকনাফে বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে মানব পাচারের অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করত। এক পর্যায়ে তাদের মানব পাচারের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হলে মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার জন্য আছেম ‘এসিএস করপোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বসে। এর ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে আরিফুজ্জামান আকন্দ ওরফে আরিফকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আছেমের সহযোগী এই আরিফ মহাখালীর একটি বেসরকারি ব্যাংকে পাচার হওয়া লোকজনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় আদায় করা মুক্তিপণের ১ কোটি ২৬ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৪ টাকা তার অ্যাকাউন্টে জমা করে। পরে এই টাকা আরিফের অ্যাকাউন্ট থেকে আছেমের মা খতিজা বেগমের ইসলামী ব্যাংকের টেকনাফ শাখায় পাঠানো হয়। এরই মধ্যে সিআইডি আছেমের মায়ের একটি অ্যাকাউন্ট নম্বরে মানব পাচারের ১ কোটি ৬১ লাখ ১ হাজার ২০৮ টাকা পেয়েছে। আছেমের ঘনিষ্ঠ একরামের একটি হিসাব নম্বরে মুক্তিপণের ১ কোটি ২৫ লাখ ৩০ হাজার ১৫১ টাকা পাওয়া যায়। আছেমের ছোট ভাই জাভেদ মোস্তফার টেকনাফের এবি ব্যাংকের শাখায় মানব পাচারের ৪ কোটি ২ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আছেম মানব পাচারের অর্থ দিয়ে টেকনাফে বাড়ি ও জমি কিনেছে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভূঁইগড়ে একটি ছয়তলা বাড়িও করেছে সে।
সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে আছেম স্বীকার করেছে, ২০১৪ সালে এই আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র সাগরপথে সিরাজগঞ্জের মাসুদকে মালয়েশিয়ায় পাচার করে। এরপর পাচারকারীরা তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে মাসুদের বাবা ব্যাংকের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা পাঠান। একইভাবে দেশের কোন এলাকা থেকে কাকে কীভাবে ফাঁদে ফেলে বিদেশে নিয়ে মুক্তিপণের অর্থ আদায় করা হয়েছে, সে ব্যাপারে সিআইডিকে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে আছেম।
সিআইডির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতার আছেম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বনানী থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে। তাদের অর্থের অনান্য উৎস বের করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আছেম ও তার সহযোগীদের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অন্তত ২০০ ব্যক্তির পরিবারের অর্থ পাঠানোর তথ্য পাওয়া গেছে, যাদের অনেকে বিদেশে গিয়ে কারাগারে বন্দি রয়েছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ মারাও গেছেন। আবার অনেকে বিদেশে নিদারুণ জীবনযাপন করছেন। সূত্র-সমকাল
Leave a Reply