জাতীয় স্বদেশ | তারিখঃ আগস্ট ১৬, ২০২০ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 472 বার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা মামলার রায় ঘোষণার ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিদেশে পলাতক পাঁচ হত্যাকারিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
এ নিয়ে সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী।
এ পর্যন্ত মামলার ১২ আসামির মধ্যে ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। একজন পলাতক অবস্থাতেই বিদেশে মারা গেছেন। বাকি পাঁচ জনের দুইজন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পলাতক আছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু পলাতক বাকি তিনজনের কোন হদিশ এতো বছরেও মেলেনি।
এই পাঁচ আসামিকে দেশে ফেরত আনার জন্য সরকার সব ধরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
তৎকালীন বিভিন্ন সরকার এই আসামীদের বিদেশের মিশনে উচ্চ পদে বসানোয় তারা বিভিন্ন নামে পাসপোর্ট করে পালিয়ে থাকার পথ সুগম করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তাদেরকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ওইসব রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা আছে উল্লেখ করে মোমেন বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছার ওপর সব নির্ভর করে না। ওই সমস্ত দেশের সহযোগিতা দরকার। তারা যেন এই খুনিদের আশ্রয় না দেয়। তারা আসামীদের ফেরত পাঠালে আমরা ধন্য হবো।’
আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়।
দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসে, সেবার প্রথমবারের মতো মামলা দায়ের হয়।
১৩ বছর ধরে চলে মামলার বিচার প্রক্রিয়া। এরপর ২০০৯ সালে বিচারিক আদালত ১৫ জনকে মৃত্যু-দণ্ডাদেশ দেয়। পরে আপিল বিভাগ ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে, এবং তিনজনকে খালাস দেয়।
এরপর ২০১০ সালে আত্মস্বীকৃত পাঁচ হত্যাকারি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা হলেন, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও একেএম মহিউদ্দিন।
চলতি বছরের এপ্রিলে আবদুল মাজেদকে গ্রেফতার করে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ছয় আসামির মধ্যে আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান। যে পাঁচজন পলাতক আছেন তাদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে আছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এছাড়া মোসলেম উদ্দিন, শরিফুল হক ডালিম এবং খন্দকার আব্দুর রশিদ পাকিস্তান, লিবিয়া, বা জিম্বাবুয়েতে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো- এনসিবি।
এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করলেও কাউকেই ফেরত আনা সম্ভব হয়নি।
এনসিবি এআইজি মহিউল ইসলাম জানান, এই রেড নোটিশ অনেকটা আন্তর্জাতিক পরোয়ানার মতো তবে পরোয়ানাতে যেমন আসামিকে ফিরিয়ে দেয়ার বা গ্রেফতার করার বাধ্যবাধকতা থাকে। রেড নোটিশে তেমনটা থাকেনা। তবে প্রতিটা দেশ অবগত হয়ে যায় যে এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে।
কেননা রেড নোটিশ জারি থাকলে ওই দেশগুলোর পুলিশের ডাটাবেজ, এনসিবির ডাটাবেস, বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে তথ্য দেয়া থাকে। ওয়েবসাইটে ছবি দিয়ে বলা থাকে যে তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ আছে।
যদি কোন দেশে থাকা আসামির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি থাকলে তখন সেই দেশটি আসামি ফেরত দেয়ার আবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে বলে তিনি জানান।
তবে ইন্টারপোলের মাধ্যমে কোনো আসামিকে ফেরত আনা যায় না। ফিরিয়ে আনার এই বিষয়টি দুই দেশের বহিঃসমর্পন চুক্তি না হলে দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে শুধুমাত্র ভারত ও থাইল্যান্ডের সাথে বহিঃসমর্পন চুক্তি আছে।
‘যেসব দেশের সাথে বহিঃসমর্পন চুক্তি নেই সেইসব দেশের সরকার আসামি ফেরত দেবে কি দেবে না সেটা অনেকটাই তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে তারা চাইলে মানবাধিকার ইস্যু তুলে আসামিকে রেখে দিতে পারে।’ বলেন ইসলাম।
সেক্ষেত্রে ইন্টারপোল পুলিশের কাজ হল আসামি ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলাকালীন মামলার কাগজপত্র বা তথ্য প্রমাণ তৈরি করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়া।
তবে যে তিন আসামির কোনো হদিশ এখনও মেলেনি তাদের খুঁজতে সিআইডি তদন্ত চালিয়েছে এবং এনসিবির কাছে সম্ভাব্য কয়েকটি দেশের নাম জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে ইসলাম বলেন, ‘সিআইডির দেয়া ওই দেশগুলোর এনসিবির সাথে বাংলাদেশের এনসিবি যোগাযোগ করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ দেশ তাদের ডাটাবেসে এই নামগুলো পায়নি। ইমিগ্রেশনেও কোনো তথ্য নেই। তবে যে দেশগুলো আমাদেরকে কোনো তথ্য দেয়নি, আমরা ধারণা করছি আসামিরা সেইসব দেশে থাকতে পারেন।’
এনসিবি ধারণা করছে শরিফুল হক ডালিম লিবিয়া বা পাকিস্তানে থাকতে পারেন। আব্দুর রশিদ লিবিয়া অথবা জিম্বাবুয়েতে এবং রিসালদার মোসলেউদ্দিন পাকিস্তান বা ভারতে থাকতে পারেন।
‘মোসলেউদ্দিন ভারতে থাকলে তাকে বহিঃসমর্পন চুক্তির মাধ্যমে ফেরত আনা সম্ভব। কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে মোসলেউদ্দিনকে আটক করা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়, আমরা ভারতকে এ নিয়ে ই-মেইল করেছি। কিন্তু দিল্লি আমাদের কোন জবাব দেয়নি।’ বলেন ইসলাম।
এদিকে যে দুজনের অবস্থানের সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাদের মধ্যে নূর চৌধুরীর ব্যাপারে কানাডীয় সরকারের একটি লিখিত নীতি আছে। সেটা হল যে দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে, সেই দেশে তারা মৃত্যু-দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফেরত পাঠায় না।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, নূর চৌধুরী কানাডায় থাকার ব্যাপারে এই বলেই আবেদন করেছেন যে, বাংলাদেশে ফেরত গেলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তবে নূর চৌধুরী আবেদনে ঠিক কি লিখেছিলেন, সেটা কানাডা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল বাংলাদেশ।
দেশটি শুরুতে তাদের গোপনীয়তা রক্ষা আইনের কথা বলে সেই তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
পরে বাংলাদেশ আদালতে গেলে, মামলার গুরুত্ব বুঝে কানাডার আদালত রায় দেয় যে, কিসের পরিপ্রেক্ষিতে কানাডীয় সরকার নূর চৌধুরীকে এখনও আশ্রয় দিয়ে আসছে, সেটা বাংলাদেশকে জানাতে হবে।
বাংলাদেশকে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র দিতেও কানাডা এখন আইনগতভাবে বাধ্য। সেই কাগজপত্র যোগাড়ের পাশাপাশি নূর চৌধুরীকে কিভাবে দেশে ফেরত আনা হবে, সেই চেষ্টা চলছে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাকে কিভাবে ফেরত আনা যায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ এছাড়া রাশেদ চৌধুরী বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ব্রাজিলে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করছিলেন।
তারপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। পরের দফায় বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যাপারটি পর্যালোচনা করছেন। বাংলাদেশ সেটা নজরে রেখেছে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply