জেলা সংবাদ | তারিখঃ মে ১০, ২০২০ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 1314 বার
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সংস্কৃতির চারণভূমি হিসাবে পরিচিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে একসময় বলা হতো সংস্কৃতির রাজধানী। অনেক দেশপ্রেমিক বিপ্লবীর এবং ক্ষণজন্মা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্মভূমি এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ভারতবর্ষের অনেক খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, বরেণ্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা জন্ম নিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতে। যারা অন্ধকারে আলোর দিশারি হয়ে এই উপমহাদেশকে আলোকিত করে গেছেন।
অনেকেরই হয়তো জানা নেই ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ী মসনদ-ই-আলা ইশা খাঁ’র জন্মভূমি ব্রাহ্মণড়িয়ার সরাইলে। তিনি ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে (মতান্তরে ১৫৩৭ খ্রি;) জন্মগ্রহণ করেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে পুরো ভারতবর্ষে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন এমনকি যারা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের অনেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। ১৯০৮ সালে ৩ মে মোজাফফরপুরে নাইটক্লাব থেকে ফেরার পথে অত্যাচারী বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টায় ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকী যে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন সেই বোমা তৈরি করেছিলেন সরাইলের কালিকচ্ছ গ্রামের সূর্য সন্তান ইঞ্জিনিয়ার বিল্পবী উল্লাসকর দত্ত।
ভারতবর্ষে কালরত্ন খ্যাত, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি, নবাব স্যার শামসুল হুদা কে সি আই ই এর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর। (উল্লেখ্য ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ এক সময় স্যার শামসুল হুদার আর্টিকল ক্লার্ক ছিলেন)। ভারতবর্ষের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার এ রসুল, বরেণ্য রাজনীতিবিদ, ব্রটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনবার কারাভোগকারী, ইন্ডিয়ান কংগ্রসের প্রভাবশালী নেতা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম প্রস্তাব উত্থাপনকারি, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণোৎসর্গকারী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা), ভারতবর্ষের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী, বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক কোম্পানি (এম ভট্টাচার্য এন্ড কোং) এবং এ্যালোপ্যাথিক কোম্পানি বেঙ্গল কেমিক্যাল এর প্রতিষ্ঠাতা, দানবীর মহশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, নবাব স্যার কাজী গোলাম মহিউদ্দিন ফারুকী এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই গর্বিত সন্তান।
এছাড়াও এই উপমহাদেশের সুরের জগতে কিংবদন্তি সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, গদ্যে প্রথম ইতিহাস লেখক ঐতিহাসিক কৈলাস সিংহ, বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর লেখক অদ্বৈত বর্মণ, কবি, লেখক, আইনজীবি ব্রাহ্মসাধক রামকানাই দত্ত, প্রখ্যাত সাধক ও বহু গানের রচয়িতা মনমোহন দত্ত, ছান্দসিক কবি আব্দুল কাদির, ছন্দ বিজ্ঞানী প্রবোধ চন্দ্র সেন, কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি মাহফুজ উল্লাহ, কবি আল মাহমুদ সবাই এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই সন্তান।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অন্যতম উপাদান পুতুল নাচ, যা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান বিপিন পালের হাত ধরেই ভারতবর্ষে সূচনা হয়েছিল। মোঘল আমলে মোরগ লড়াইয়ের সূচনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থেকেই হয়েছিল বলে জানা যায়। যা আজো বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় খেলা।
দেশের প্রখ্যাত সাধক হযরত সৈয়দ আহমেদ গেছুদরাজ কল্লা শহীদ (রাঃ), হযরত কাজী মাহমুদ শাহ (রাঃ), হযরত সৈয়দ শাহ শের আলী (রাঃ), হযরত মাওলানা আসগর আহমেদ (রাঃ), হযরত ফখরে বাঙাল তাজুল ইসলামসহ অনেক ইসলামী মহান ব্যক্তিত্বের পূণ্যভূমি এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবদান অনস্বীকার্য। ভারতের বিস্তীর্ণ সীমানা ঘেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ২ এবং ৩ নাম্বার সেক্টর জুড়ে ছিল ব্রাহ্মণবাড়য়া জেলা। আখাউড়া এবং আশুগঞ্জে যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর সন্তান লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল একাত্তরে আশুগঞ্জ হয়ে উজানিসার ব্রীজের নীচ দিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন (আমার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং আশুগঞ্জ’, ও ‘শেকড়ের সন্ধানে’, গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও গেরিলা উপদেষ্টা মরহুম এডভোকেট লুলফুল হাই সাচ্চু, সাবেক সেনাপ্রধান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাব-সেক্টর কমান্ডার জেনারেল নাসিমসহ এই জেলার অনেক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। ঢাকসুর সাবেক জিএস, চার খলিফার একজন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাতীয় বীর আব্দুল কুদ্দুস মাখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গর্বিত সন্তান।
সরকারির বেসরকারি উচ্চ পদস্থ এমন অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তিত্ব জন্ম নিয়েছে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। যারা শুধু বাংলাদেশেই নয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্যাস দিয়ে সারা বাংলাদেশের মিল-ফ্যাক্টরি চলে, আশুগঞ্জে গ্যাসের বাল্ব স্টেশন বন্ধ হলে সারাদেশের মিল-ফ্যাক্টরি-গ্যাসের চুলা বন্ধ হয়ে যায়। আশুগঞ্জের বিদ্যুৎ দিয়ে সারাদেশ আলোকিত হয়, আশুগঞ্জের সার কারখানার উৎপাদিত সার দিয়ে সারা দেশের কৃষি সচল থাকে, আশুগঞ্জের চাল দিয়ে বাংলাদেশের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। এছাড়াও বিপুল পরিমাণে রেমিটেন্সসহ জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ যোগান দেয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
তবে সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রসিদ্ধ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে, জেলার নাসিরনগর, সরাইল, নবীনগর, কাজীপাড়া ও বাঞ্চারামপুরের কয়েকটি মারামারি ও সংঘর্ষের ঘটনা জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। চলমান করোনা সংকটের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা যেখানে সরকারি নির্দেশনা, সেখানে জেলার সরাইলের স্থানীয় খেলাফত নেতার জানাজায় লক্ষাধিক লোকের জনসমাগম নজর কেড়েছে সবার। বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
সাংবাদিক আনিস আলমগীর লিখেছেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বাংলাদেশের কয়েকটা এলাকাকে মনে হয় ‘পাকিস্তানের ছিটমহল’। কথায় কথায় অস্ত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে, গায়ের জোর দেখায়। মানবতার প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই-এইসব জনপদে। মনে হয় না এখানে মানুষ বাস করে। অন্তত মানুষের আচরণ এইসব জনপদে দেখা যায় না।
গোলাম সামদানী নামের একজন লিখেছেন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে লাখ লাখ লোকের উপস্থিতেতে আজ ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। লকডাউনের ইতিহাসে সরাইলের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
কারণ যেখানে বাবা মারা গেলে ছেলে তার জানাজায় অংশ গ্রহণ করা তো দুরের কথা লাশ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে। আত্নীয় স্বজন পরিচয় দিচ্ছে ননা। সেখানে এই ধরনের ঘটনা কিভাবে সম্ভব হলো? এটা বিরল ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও সামাজিক দূরত্বের নিয়ম লঙ্ঘন করে লাখো মানুষ জানাজায় অংশ নিয়েছেন। এতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়লেও পুলিশ বলছে, বিষয়টি নিয়ে তাদের কিছু করার ছিল না। উৎস -একুশে টিভি অনলাইন
Leave a Reply