জাতীয় স্বদেশ | তারিখঃ জানুয়ারি ২০, ২০২০ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 745 বার
ভারতের পার্লামেন্টে গত মাসে পাস হওয়া সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রয়োজনীয় ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরকালে গাল্ফ নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন তিনি। তবে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সাক্ষাৎকারে সিএএসহ রোহিঙ্গা ইস্যু, ভারত থেকে পাল্টা অভিবাসন, কয়লা শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি নিয়েও কথা বলেছেন তিনি।
সিএএ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বুঝলাম না তারা (ভারত সরকার) এটা কেন করলো। এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না।’ উল্লেখ্য, গত ১১ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস করে ভারতের পার্লামেন্ট। আইন অনুসারে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যাওয়া ৬টি সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এই তিন দেশ থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা যদি ভারতে ২০১৫ সালের আগে গিয়ে থাকে তাহলে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে।
আইনটিতে মুসলিমদের বাদ দেয়ায় তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সিএএ ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এতে ভারত থেকে মুসলিমরা নিপীড়নের ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসবে।
১৬ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ হিন্দু এবং দশমিক ৬ শতাংশ বৌদ্ধ অধ্যুষিত বাংলাদেশ ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে কারো দেশত্যাগের কথা অস্বীকার করেছে।
এদিকে, ভারত থেকে অভিবাসন হওয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, না, ভারত থেকে পাল্টা অভিবাসন হয়নি। কিন্তু ভারতের ভেতরে মানুষ নানা সমস্যায় ভুগছে।
গত মাসে সিএএ কার্যকর হওয়ার পর থেকে ভারতজুড়ে প্রতিবাদ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভারত সরকার ঘোষণা করেছে যে, জাতীয় নাগরিক নিবন্ধক (এনআরসি) দেশব্যাপী পরিচালিত হবে। বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যে ভারতীয় মুসলমানরা তাদের নাগরিকত্বের দাবি প্রমাণ করতে পারছেন না তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেবেন।
পুরো বিষয়টিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই সিএএ ও এনআরসিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই দেখে আসছে। ভারত সরকার, তাদের দিক থেকে বলেছে যে, এনআরসি ভারতের নিজস্ব ব্যাপার। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র) মোদি গত অক্টোবরে আমার নয়া দিল্লি সফরে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান করতে হবে
শেখ হাসিনার মতে, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। বিস্তৃত ঘরানার খাতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বজায় রয়েছে। তবে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে তিনি কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট উদ্ভ‚ত হয়েছিল মিয়ানমারে। এর সমাধানও তাদের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমার নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের প্রধান উদ্বেগগুলো নিয়ে কোনো অর্থবহ উদ্যোগ নিচ্ছে না। দুটি প্রত্যাবাসন উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, কারণ একজন রোহিঙ্গাও স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে চায় না। এতে প্রমাণ হয় যে, মিয়ানমার প্রত্যাবসনের জন্য অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এই সঙ্কটের বোঝা বাংলাদেশকে একাই বইতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এই সমস্যা যদি চলতে থাকে তাহলে এতে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা গুরুতরভাবে আক্রান্ত হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিৎ এ সঙ্কটের সমাধা না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থাকা।
কয়লা শক্তি
বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণায় পরিবেশবাদীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিলেও প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন যে, এতে বিস্তৃত পরিমাণে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে এর মাত্র ২.৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করে। ভবিষ্যতে এ পরিমাণ ২৫ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের কার্বন নিসরণের হার খুবই কম। আমাদের উন্নয়ন এজেন্ডা পূরণে ‘কার্বন স্পেস’ যৌক্তিক পরিমাণে বাড়াতে দেয়া উচিৎ।
আবুধাবি সাসটেইন্যাবিলিটি উইকে সফরকালে ওয়াল্ড ফিউচার এনার্জি সামিটের উদ্বোধনে অংশ নেয়া শেখ হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছিলেন, টেকসইয়ের ওপর এক সপ্তাহের গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী স্থায়িত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে নতুন ধারণা তৈরি করতে সহায়তা করবে।
‘এই প্রথম আমি (আবু ধাবি টেকসই সপ্তাহে) যোগ দিচ্ছি, আর আমিরাতের এটি খুব ভাল উদ্যোগ। ‘অনেক (নতুন) ধারণা (এবং উদ্ভাবন) করার সুযোগ রয়েছে এবং সেখানে (জায়েদ টেকসই পুরস্কার) রয়েছে’ -বলেন তিনি।
নতুন কয়লা শক্তি কেন্দ্র
বাংলাদেশ যদিও আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার মধ্যে রয়েছে তথাপি ২০১৬ সালে প্রথম বারের মতো দেশে ২৯টি নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল।
পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, উপক‚লীয় পানিবদ্ধতার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে বসবাসরত ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার হুমকির মধ্যে রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মতো দেশের সমস্ত বড় নদীনদীর তীর ভাঙনও উদ্বেগের বিষয়। ‘বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলায় প্রথম কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ২২ বছর কেটে গেছে। আমরা (বেশি) পরিবেশগত ক্ষতি দেখিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সফরে গিয়ে দেখেছি,’ -শেখ হাসিনা বলেন।
অতীতে, দেশ প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে তার বিদ্যুতের অনেকটাই উৎপাদন করেছে।
‘এক দশক আগে, বিদ্যুৎ উৎপাদন মিশ্রণের ৯০ শতাংশেরও বেশি গ্যাস থেকে হয়েছিল। তবে গৃহস্থালির গ্যাস (মজুদ) দ্রæত কমছে। সুতরাং বিকল্প হলো কয়লা, তরল জ্বালানী, পরমাণু শক্তি,’ -বলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা ব্যাখ্যা করেন যে, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম বলে অনুমান এবং এর উন্নয়ন বিদ্যমান সম্পদে চাপ সৃষ্টি করেছে।
‘আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৯৫% বিদ্যুত ব্যবহার করতে পারে। তবে (এই) জনসংখ্যা অর্থনৈতিকভাবে বিকাশ লাভ করছে এবং মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তাদের মোবাইল ডিভাইস, কম্পিউটার এবং ডিজিটাল ক্লাসরুমগুলিকে বিদ্যুতাায়িত করার জন্য তাদের আরও বিদ্যুতের প্রয়োজন’।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনে এবং বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট রয়েছে, পাশাপাশি নেপাল, ভারত ও ভুটানের সাথে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি রয়েছে। এখন মধ্য বাংলাদেশে একটি ২.৪ গিগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছে।
‘অনেক বছর আগে বাংলাদেশ সৌরশক্তি প্রতিষ্ঠা করেছে (এবং) গ্রিড বিদ্যুৎবিহীন অঞ্চলগুলিতে এটিই (মূল উৎস)। সারা দেশে প্রায় ৫৩ লাখ সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে,’ -জানান তিনি।
শেখ হাসিনা আরও জানান, কয়লার দাহ্য থেকে প্রাপ্ত ফ্লাই অ্যাশ স্থানীয় সিমেন্ট শিল্পও ব্যবহার করতে পারবে।
প্লাস্টিক নিষিদ্ধ
ইতিমধ্যে, দেশটি সম্প্রতি উপক‚লীয় অঞ্চলে এবং হোটেল এবং রেস্তোরাঁগুলিতে প্লাস্টিকের একক ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, যদিও ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞার যথাযথ প্রয়োগ করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে, পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে, সাশ্রয়ী মূল্যে ভাল বিকল্পের অযোগ্যতা এবং এই ব্যাগগুলি উৎপাদন করতে ব্যবহৃত কাঁচামালকে সীমাবদ্ধ করতে অসুবিধার কারণে বাংলাদেশ এখনও পুরোপুরি সফল হয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন আমাদের কাছে আরও ভাল বিকল্প রয়েছে, যেমন ভুট্টা, কাসাভা এবং ফসলের অবশিষ্টাংশ থেকে জৈব বিস্তৃত ব্যাগ। আমাদের একজন বিজ্ঞানী পাট সেলুলোজ থেকে একটি বায়োডেগ্র্যাডেবল ব্যাগও আবিষ্কার করেছেন, যা বাংলাদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি এর নাম দিয়েছি ‘সোনালী ব্যাগ’ এবং টেক্সটাইল ও পাট মন্ত্রণালয়কে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাগ উৎপাদন এবং স্বল্প ব্যয়ে এগুলো সরবরাহের নির্দেশনা দিয়েছি’।
Leave a Reply