জাতীয় স্বদেশ | তারিখঃ ডিসেম্বর ২০, ২০১৯ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 887 বার
পৌষ মাসের শুরুতে হঠাৎই জেঁকে বসেছে শীত। রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের উপর দিয়ে মৃদ শৈত্য প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এসব অঞ্চলের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এসেছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, আজ বৃহস্পতিবার চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন ৭.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
রাজধানীতে ঠাণ্ডা বাতাসে কাবু মানুষ। ২৪ ঘণ্টা আগেও যেখানে পাতলা জামাকাপড় গায়ে চড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব ছিল; ২৪ ঘণ্টা পর মোটা জ্যাকেট অথবা এ রকম কিছু গায়ে দিয়ে বাইরে বের হতে দেখা গেছে মানুষকে। শিশুরা ভারী জ্যাকেট চাপিয়ে মাথায় ওলের টুপি পরে, পায়ে ফোম মোড়ানো কেডস পরে খোলা রাস্তায় অথবা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে শীত উপভোগ করলেও বয়স্করা ভারী জামাকাপড় গায়ে দিয়েও শীত মানাতে পারছেন না। এই অবস্থা গতকাল বুধবারের আগের দিন মঙ্গলবার রাতের বেলায়ও শীতটা তেমন অনুভূত হয়নি। এ মওসুমে এটিই রাজধানীবাসীর প্রথম শীত। ডিসেম্বর এলেই সাধারণত শীতের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে মানুষ। কিন্তু এ বছর শীতটা যেন আসছিল না। দুপুরে রোদের তেজ মোটেও কমছিল না। একটু পরিশ্রম করলেই শরীরে ঘাম বের হয়ে যেত।
আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে শীত আরও বাড়বে। বৃহস্পতিবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নামে রাজারহাটে ১০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশেই তাপমাত্রার পারদ নিচে নেমে যেতে পারে। আজ দিনের বেলা ঠাণ্ডা আরও বাড়তে পারে। গতকাল রাতের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল আবহাওয়া অফিস। সর্বত্র দুই ডিগ্রি না কমলেও কোথাও কমপক্ষে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে। আগামী তিন দিন তাপমাত্রা কমতে থাকবে এমনই ইঙ্গিত দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
রাজধানীর বাইরে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রংপুর ও দিনাজপুর এলাকার মানুষের এর চেয়েও বেশি মাত্রার শীতের অভিজ্ঞতা হয়েছে বেশ কয়েকদিন থেকেই। বাংলাদেশের অন্যতম ঠাণ্ডা এলাকা তেঁতুলিয়ার তাপমাত্রা চলতি ডিসেম্বর মাসের পাঁচদিন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছিল। চলতি মওসুমে সবচেয়ে নিচে নেমেছে ৮ ডিসেম্বর। সেদিন ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় তেঁতুলিয়ায়। সেদিন এটিই ছিল দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা। সে তুলনায় রাজধানীর এই শীতটা কিছুই না। গতকাল সকালে রাজধানীর সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১৬.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
হঠাৎ এতো ঠাণ্ডা কেন? আবহাওয়া অফিস বলছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে একটি ঠাণ্ডা হাওয়া এ সময় ভারতের বিহার হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত আসে। এর একটি ধাক্কা বাংলাদেশের রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের কয়েকটি অঞ্চলে এসে লাগে। ওই ঠাণ্ডা বাতাসকে ‘উপমহাদেশীয় উচ্চ চাপ বলয়’ বলা হয়ে থাকে আবহাওয়ার ভাষায়। বৃহস্পতিবার এই উপমহাদেশীয় উচ্চ চাপ বলয় পশ্চিমবঙ্গের আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই এত ঠাণ্ডা। ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত রাজধানী ঢাকার চেয়ে রাজধানীর বাইরে অন্যান্য জেলার তাপমাত্রা আরও নিচে নেমে গেছে।
ঢাকা বিভাগের মধ্যে গতকাল টাঙ্গাইলে সর্বনি¤œœ তাপমাত্রা ছিল ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এটি এ বিভাগের সবচেয়ে কম তাপমাত্রা। এর বাইরে রাজশাহী বিভাগের তাপমাত্রা ঢাকা বিভাগের তাপমাত্রার চেয়ে আরও কম ছিল। রাজশাহী বিভাগে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহী শহরে ১১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খুলনা বিভাগের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ১১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ময়মনসংিহ বিভাগের সর্বনি¤œ ছিল নেত্রকোনায় ১২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বরিশাল বিভাগের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা বরিশাল শহরে ১৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চট্টগ্রাম বিভাগে গতকাল সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল কুমিল্লায় ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) সংবাদদাতা জানান, তেঁতুলিয়ায় তীব্র শীতে ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। পৌষ-মাঘ এ দুই মাস শীতকাল হলেও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দুই মাস আগে থেকেই এবার শীত শুরু হয়েছে। গত বছর শীতে তেঁতুলিয়ায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ২৪ ঘণ্টায় তেঁতুলিয়ায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করছে। হিমেল বাতাস ও ঘন কুয়াশার কারণে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। ফলে আগামী সপ্তাহে শীত আরও তীব্র হতে পারে।
গত দুই দিনে তেঁতুলিয়ার কোথাও সূর্য দেখা যায়নি। সারা দিন ছিল শৈত্যপ্রবাহ। তীব্র শীতের কারণে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হননি। শীতের কারণে অফিস, হাট-বাজার ও পথঘাট ছিল অনেকটা জনশূন্য। ঠাণ্ডা পানির কারণে মহানন্দা নদী থেকে পাথর উত্তোলনের জন্য কোনো শ্রমিক নামেনি। শীত নিবারণের জন্য গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষকে খড়কুটা জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে দেখা গেছে। এলাকায় পুরাতন মোটা কাপড়ের দোকানে গরিব মানুষের ভিড় বেড়েছে। তবে এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা কাপড়ের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জাকির হোসেন জানান, চলতি বছরে চার হাজার কম্বল বরাদ্দ পেয়েছি। ইতোমধ্যে ৪০০ করে কম্বল সাতটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে বিতরণের জন্য দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন এতিমখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে। বাড়তি শীতবস্ত্র চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানিয়েছেন, গত দুই দিন ধরে কুড়িগ্রামে শৈত্যপ্রবাহের কারণে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। তাপমাত্রা ১০-১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠা নামা করছে। বুধবার সারা দিনই কুয়াশার চাদরে আবৃত্ত ছিল কুড়িগ্রাম। সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। তীব্র ঠাণ্ডার সাথে হিমেল বাতাসের কারণে শিশু ও বৃদ্ধরা শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ২৭ জন শিশুসহ ৩১ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টাায় নতুন করে ছয়জন ডায়রিয়া ও তিনজন নিউমোনিয়া রোগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় মেঝেতেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে আক্রান্তদের।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: জাকিরুল ইসলাম জানান, শীতজনিত রোগের প্রকোপ ব্যাপক আকারে দেখা দেয়নি। ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ শীতজনিত রোগের সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার জানান, দু-একদিনের মধ্যে তাপমাত্রা আরও হ্রাস পেয়ে জেলায় শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। ২৪ কিংবা ২৫ ডিসেম্বর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও রয়েছে।
বগুড়া অফিস জানায়, বগুড়াসহ উত্তর জনপদে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা শুরু হয়েছে। সারা দিন সূর্যের আলো পড়েনি। ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে শীত জেঁকে বসেছে। এতে ছিন্নমূল মানুষ, শিশু ও বৃদ্ধমানুষ ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে পড়েছেন। বুধবার সকাল থেকেই বগুড়ায় বাতাস বইতে থাকে। বগুড়া শহরের জশে^রীতলাস্থ ভাইবোন স্কুলের ছাত্র মুনতাসির আব্দুল্লাহ জারিফ বলে, হঠাৎ শীত শুরুর কারণে অনেক কষ্ট হচ্ছে। একই ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করেন সূত্রাপুরের গৃহবধূ মনিরা বেগম।
পঞ্চগড় সংবাদদাতা জানান, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লেও উত্তরের কনকনে শীতল হাওয়ায় পঞ্চগড়ে বেড়েছে শীতের তীব্রতা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে খেটে খাওয়া ও ছিন্নমূল মানুষগুলো। দিনমজুর শ্রেণীর মানুষ তীব্র শীত উপেক্ষা করেই কাজে বেরিয়েছেন। চটের বস্তা গায়ে দিয়ে গবাদিপশুগুলোকে শীতের কবল থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন কৃষকরা। ভিড় বেড়েছে পুরনো শীতবস্ত্রের দোকানগুলোতে। নিজেদের সাধ্যমত শীতবস্ত্র কেনা চেষ্টা করছে শীতার্ত মানুষ।
সারা দিন মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার আগে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। এরপর থেকে সূর্যের মুখ দেখা গেলেও মাঝে মধ্যে তা মেঘের কোলে ঢুকে পড়ায় খুব একটা তাপ অনুভূত হয়নি। শহরের অনেক জায়গায় দিনের বেলাতেও শীতার্ত মানুষকে আগুন জ্বেলে শীত নিবারণের চেষ্টা করতে দেখা গেছে।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন জানান, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ২৮ হাজার কম্বল পাওয়া গেছে, যা ইতোমধ্যে উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় হয়ে গ্রামাঞ্চলের শীতার্ত মানুষের মধ্যে বিতরণ শেষ হয়েছে। আরও নতুন করে শীতবস্ত্র চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়েও বিভিন্ন ধরনের শীতবস্ত্র পঞ্চগড়ের শীতার্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) সংবাদদাতা জানান, গত দুই দিন ধরে হিমেল হাওয়া ও কনকনে ঠাণ্ডায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চন্ডিপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নে তিস্তার চরাঞ্চলের অসহায় মানুষেরা ঠাণ্ডায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত সূর্যের দেখা মেলেনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোলেমান আলী জানান, এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৯ হাজার ৩৯০টি শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।
নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, নীলফামারীতে হাড় কাঁপানো শীত জেঁকে বসেছে। গত তিন দিন ধরে ঘন কুয়াশা আর উত্তরের হিমেল বাতাসে জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন এ জেলার নি¤œ আয়ের মানুষ। তীব্র শীতের কারণে তারা কাজে যেতে পারছেন না।
ঘন কুয়াশার কারণে দুপুর পর্যন্ত সূর্যের দেখা মিলছে না। যানবাহনগুলোকে দিনেও হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত জেলায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এ দিকে শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় নীলফামারী হাইস্কুল মাঠের খোলা শীতবস্ত্রের বাজারে ভিড় বেড়েছে।
Leave a Reply