‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে গড়তে সোনার দেশ, এগিয়ে চলেছি দুর্বার, আমরাই তো বাংলাদেশ’ এ স্লোগান সামনে রেখে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলটির দুই দিনব্যাপী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলন আজ শুরু হচ্ছে। আগামী বছর মুজিববর্ষ সামনে রেখে রাজসিক সম্মেলনের চিন্তা বাদ দিয়ে এবার সাদামাটাভাবে সম্মেলন করতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি। ইতোমধ্যে সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সম্মেলনের মাঠ পরিদর্শন করেন দলের সাধারণ সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। এ সময় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, গত জাতীয় নির্বাচনের অঙ্গীকার, নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ ও প্রতিশ্রুতি মোকাবেলা করে মানুষের সামনে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত, মডার্ন ও স্মার্ট হিসেবে উপহার দিতেই সম্মেলন হতে যাচ্ছে।

এ দিকে বরাবরের মতো এবারো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সভাপতি পদে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়ে সাধারণ সম্পাদক নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। এ পদে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই বহাল থাকবেন নাকি অন্য কেউ তা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে আলোচনার শেষ নেই। পরিবর্তন হলে এ পদে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের নাম বিভিন্ন মহলে জোর আলোচনায় রয়েছে। তবে গত জাতীয় সম্মেলনের আগে ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার ‘সবুজ সঙ্কেত’ পেলেও এবার এখন পর্যন্ত কোনো নেতাকেই সেই সঙ্কেত দেয়া হয়নি বলে দলের সূত্রগুলো জানিয়েছে।

ঘোষণা অনুযায়ী আজ শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকাল শনিবার উদ্যানসংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শুধু কাউন্সিলরদের নিয়ে হবে দ্বিতীয় অধিবেশন। এ অধিবেশনের মাধ্যমে পরবর্তী তিন বছরের জন্য দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। গতকাল সরেজমিন সম্মেলনস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সম্মেলনের প্রস্তুতি ঘিরে ব্যস্ত সবাই। কারো যেন কোনো দিকে তাকানোর অবসর নেই। প্রমত্তা পদ্মার বুকে ৪০টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা সেতু, সেটি এখন দৃশ্যমান প্রায়। পদ্মা সেতুর সামনের বিশাল জলরাশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট নৌকা। একপাশে চরে জেগে আছে শুভ্র কাশবন। এমনই একটি আবহের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিশালাকার এক পালতোলা নৌকা। তাতে আবার জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতি। মূল মঞ্চের পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ছবি ছাড়াও ঠাঁই পেয়েছে জাতীয় চার নেতাÑ তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছবি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম চার নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের ছবি রাখা হয়েছে সেখানে।

সম্মেলনে এবার তাৎপর্যের দ্যুতি ছড়াবে মূল মঞ্চটি। এটি করা হয়েছে বিশাল আকৃতির নৌকার আদলে। মঞ্চের সামনে রয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতুর আদল। মূল মঞ্চটি ১০২ ফুট দীর্ঘ, ৪০ ফুট প্রশস্ত। নৌকার পালগুলোতে থাকছে দলীয় প্রতীক ও দলীয় নেতাদের মুখচ্ছবি। সম্মেলনস্থলের ভেতরে চার পাশে থাকবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাসের পরিক্রমাসংবলিত বিশাল বিশাল ব্যানার-ফেস্টুন। এ ছাড়াও থাকবে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের সময় অগ্নিসংযোগ ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক রাজনীতির চিত্রায়ন।

দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পালিত হবে মুজিববর্ষ। দেশ-বিদেশে মুজিববর্ষের জাঁকজমক ও বর্ণিল আয়োজন সামনে রেখে তাই গত সম্মেলনের তুলনায় এবার সাদামাটা সাজসজ্জার মধ্য দিয়েই সম্মেলন করা হচ্ছে। কেবল সম্মেলনস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে নজরকাড়া সাজসজ্জা ও আলোর ঝলকানি। ব্যানার-ফেস্টুনও থাকবে কেবল উদ্যান ঘিরে। সম্মেলন সফল করার লক্ষ্যে ১১টি উপকমিটির নেতারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

জানা গেছে, এবারের সম্মেলনে ব্যয় ধরা হয়েছে চার কোটি টাকা। সারা দেশ থেকে সাড়ে সাত হাজার কাউন্সিলর ও ১৫ হাজার ডেলিগেটসসহ ৫০ হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত থাকবেন। এ উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দলীয় সভাপতির ধানমন্ডির কার্যালয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। সম্মেলনে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।

সাংস্কৃতিক উপকমিটির সদস্যরা জানান, সম্মেলনে ২০ থেকে ২৫ মিনিট ইতিহাসনির্ভর, মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশ শিরোনামে গীতিনাট্য পরিবেশন করা হবে। এখানে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীরা থাকবেন। এ ছাড়াও থাকবেন তিন প্রজন্মের শিল্পীরা। এরা জাতীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোরাস গান পরিবেশন করবেন। এ ছাড়াও সন্ধ্যায় হবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এ দিকে আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে দলের সভাপতি পদে যে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই, সেটি নিশ্চিত। সে জন্য এখন সবার আগ্রহ-আলোচনা সাধারণ সম্পাদক পদ ঘিরেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সম্পাদকমণ্ডলীর অন্তত সাতজন সদস্য জানান, বিগত সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর তৎকালীন সদস্য ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। সম্মেলনে তিনি কণ্ঠভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেও বিষয়টি আগে থেকেই অনেকটা চূড়ান্ত ছিল। তবে এবারের সম্মেলনে কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক তা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছ থেকে কোনো ধরনের ইঙ্গিত দেয়া হয়নি।

সম্পাদকমণ্ডলীর তিনজন সদস্য বলেন, ‘বর্তমান সাধারণ সম্পাদককে পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে কোনো সঙ্কেত নেত্রী দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। তবে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক যদি পুনরায় দায়িত্ব না পান তাহলে দলের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য, একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, একজন সাংগঠনিক সম্পাদক অথবা সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য থেকে কেউ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেতে পারেন বলে ধারণা করছি।’
ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় এক ডজন নেতার নাম বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনায় এলেও বর্তমান সাধারণ সম্পাদকসহ চারজন নেতাই এ পদের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। ওই চার নেতার অনুসারীরা মনে করেন, এদের মধ্য থেকে যে কেউ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেলে আওয়ামী লীগের আগামী দিনের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক অবস্থান আরো পোক্ত হবে। অবশ্য আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুসারীরা নিজ নিজ নেতাকে আগামী দিনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেখতে চান। সেই আকাক্সক্ষা নিয়ে আজকের জাতীয় সম্মেলনে যোগ দেবেন তারা।

দলে পরিবর্তন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘একটা পদে কোনো পরিবর্তন আসবে না। সেটি হচ্ছে আমাদের পার্টির সভাপতি দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তিনি ছাড়া আমরা কেউ অপরিহার্য নই। তিনি এখনো আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য। তৃণমূল পর্যন্ত সবাই তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। এর পরের পদটা কাউন্সিলরদের মাইন্ড সেট করে দেয়। সেটিও তিনি (সভাপতি শেখ হাসিনা) ভালো করে জানেন। আর কমিটিতে যাদের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না তাদের পদে পরিবর্তন হবে।
১৯৪৯ থেকে ২০১৯

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে। ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত দলীয় কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামকরণের মাধ্যমে দলটি অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। এখন দলটি প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পার করছে। এ পর্যন্ত দলের ২০টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে ২৩ ও ২৪ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে প্রথম জাতীয় সম্মেলনে প্রতিনিধি ছিলেন প্রায় ৩০০ জন। উদ্বোধনী ভাষণ দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পরে প্রতিনিধিদের সমর্থনে ৪০ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। তখন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে বন্দি। বন্দি অবস্থায় তাকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রথম কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩ সালে ৩, ৪ ও ৫ জুলাই ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে দলের দ্বিতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন। সর্বশেষ দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।