অপরাধ সংবাদ | তারিখঃ ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 526 বার
চলতি ডিসেম্বর মাসেই বোয়িংয়ের একটি বিমান ডেলিভারি নিতে বাংলাদেশের ৪৫ জনের প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাবেন, সম্প্রতি গণমাধ্যমে এমন খবর বের হবার পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে বেশ হাস্যরস সৃষ্টি হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে দুইটি বিমান কিনতে দুই দফায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা রয়েছে দুটি সরকারি দলের। ওই দুই দলের প্রতিটি দলে ২২ জন করে সদস্য থাকবে এবং দুই দলের একজন সমন্বয়ক থাকার কথা রয়েছে।
বেসরকারি বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায় দুই দফায় মোট ৪৫জন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে সফর করবেন। যেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা সহ বেশ কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার, কেবিন ক্রু এবং এয়ার হোস্টেসও থাকবেন। তবে বেসরকারি বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ঐ কর্মকর্তা মন্তব্য করেন দুটি বোয়িং ড্রিমলাইনার কিনে, প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে এবং তা চালিয়ে দেশে নিয়ে আসতে এই পরিমাণ কর্মকর্তা প্রয়োজন। কাজেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে এই দলে কেউ সফর করছেন না।
এর আগেও একটি ক্যামেরা কিনতে তিনজনের বিদেশ যাওয়া, নলকূপ খনন শিখতে একাধিক কর্মকর্তার বিদেশে সফর নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা তৈরি হয়েছে। কিছুদিন আগে একটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরে নিরুৎসাহিত করে সুপারিশ পেশ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কাজের খাতিরে, প্রশিক্ষণের প্রয়োজনে, বিশেষ কোনো বিষয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত বা ব্যবস্থাপনার জ্ঞান আহরণ করতে অথবা কোনো কিছু ক্রয়ের উদ্দেশ্যে সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর করার বিষয়টি স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের এই বিদেশ সফর অনেকসময়ই আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক কারণে হয়ে থাকে।
অনেক সময় সফরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হয়। এসব ক্ষেত্রে নানা বিতর্কের জন্ম দেয় সরকারি খরচে ঐসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফর। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এধরণের সফর নীতিমালা অনুসরণ করেই করা হয়, কিন্তু এসবের প্রয়োজনীয়তা কতটা – তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সামান্য কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি বাংলাদেশে কতটা প্রকট তা বোঝা যায় মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য থেকে।
ওই বৈঠকের পর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেন যে, প্রকল্পের অজুহাতে সরকারি কর্মকর্তারা যেন ‘অহেতুক’ বিদেশ সফর না করেন সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামানের মতে, সরকারি দপ্তর ও কাজের জায়গায় দুর্নীতি যে অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এরকম সফরগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রকল্পের ক্ষেত্রে বা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফর স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের সফরের প্যাটার্ন দেখলেই বুঝতে পারবেন যে আইনি কাঠামো ও নীতিমালার মধ্যে থেকেই এই ধরণের সফরগুলো ব্যবস্থা করা হয়, যেগুলো একেবারেই প্রয়োজনহীন, কিন্তু আবার অবৈধও নয়।’
এবছরে আলোচনা তৈরি করা সরকারি কর্মকর্তাদের কয়েকটি সফরের ঘটনা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :
১. পুকুর খনন শিখতে বিদেশে
গত অগাস্টে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নেয়া একটি প্রকল্পের অধীনে পুকুর খননে দক্ষতা অর্জন করতে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেন। সে সময় এ বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনা তৈরি হলেও প্রকল্পের সাথে জড়িতরা যুক্তি দেখিয়েছিলেন ঐসব দেশে দক্ষতার সাথে কীভাবে এবং কী প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির ওপরের বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা হচ্ছে – সে সম্পর্কে জানতেই সফর আয়োজন করা হয়েছে।
২. লিফট কিনতে ইউরোপ
কয়েকমাস আগে ময়মনসিংহের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষক ও কর্মকর্তার লিফট কিনতে সুইজারল্যান্ড ও স্পেন যাওয়ার খবর ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সফরের তালিকায় নাম থাকলেও সমালোচনার মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তালিকা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করেন। সফরের দলে থাকা আটজনের মধ্যে ছয়জনেরই লিফট সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই বলে সেসময় অভিযোগ ওঠে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য সেসময় জানিয়েছিলেন যে বিধি মোতাবেক নিয়ম মেনেই ঐ কর্মকর্তারা যাচ্ছেন সফরে।
৩. প্রতিযোগী ছাড়াই পুরস্কার আনতে যুক্তরাষ্ট্রে
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দেয় এবছরের জুলাই মাসের একটি ঘটনা।সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা নাসা’র আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়। তাদের পুরস্কৃত করতে নাসার পক্ষ থেকে ফ্লোরিডায় আমন্ত্রণ জানানো হয় দলটিকে।
বিজয়ী দলের সদস্যদের সাথে যাওয়ার জন্য সরকারি খরচে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তারও ভিসা আবেদন করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা থাকার কারণে নাসা’র আমন্ত্রণ পাওয়া প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলের সদস্যরা কেউ যাওয়ার অনুমতি পায়নি। মজার বিষয় হলো, আসল প্রতিযোগীরা অনুমতি না পেলেও তাদের সহযোগী হিসেবে যাদের যাওয়ার কথা ছিল, সেই সরকারি কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে আসেন সরকারি খরচে।
৪. নিরাপদ পানির জন্য উগান্ডায় প্রশিক্ষণে ৪১ জন : আফ্রিকার দরিদ্র দেশ উগান্ডায় নিরাপদ পানির ভীষণ সংকট। প্রতিদিন সেখানে নীরব দুর্ভিক্ষ চলে। সেখানে উন্নত পয়োনিষ্কাশন সুবিধারও অভাব। অথচ চট্টগ্রাম ওয়াসা তাদের ২৭ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে প্রশিক্ষণের জন্য এই দরিদ্র দেশে পাঠিয়েছে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের আরও ১৪ জন কর্মকর্তাও দেশটি ভ্রমণে গেছেন। ওয়াসার একজন কর্মকর্তা জানান, এসব সফরে ব্যয় হয়েছে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে এ ব্যয় বিশ্বব্যাংক বহন করলেও পরে সুদে-আসলে তা ওয়াসাকেই পরিশোধ করতে হবে।সূত্র-বিবিসি বাংলা
Leave a Reply