নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদেগতকাল সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেছে এগারো জেলার পরিবহন শ্রমিকরা। পূর্বঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ এই ধর্মঘটে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা।

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ আনুষ্ঠানিকভাবে ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে গতকাল রোববার থেকে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এর প্রতিবাদে উত্তর ও দক্ষিণের জেলাগুলোর মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও রাজশাহীতে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকরা। অন্যদিকে যশোরে গতকাল থেকেই কোনো বাস চলাচল করছে না।

অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে কুষ্টিয়া থেকে আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও ঢাকার সঙ্গে চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। জেলার মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাহবুবুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, বৃহস্পতিবার রাতে বৈঠক করে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কুষ্টিয়া থেকে রাজবাড়ি, খুলনা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও পাবনার দিকে কোনো বাস ছেড়ে যাচ্ছে না।

ওই পরিবহন নেতা বলেন, ৭০ শতাংশ বাস চালক ও হেলপারের লাইসেন্স নেই। ফলে তারা বাস চালানো বন্ধ রেখেছেন।

বাস চলাচল বন্ধ থাকায় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার মতো বিকল্প যানবাহনে গন্তব্যে যাচ্ছেন যাত্রীরা।

তবে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এসএম তানভির আরাফাত বলেছেন, সরকারের নির্দেশনা অনুসারে তারা এই আইন প্রয়োগে প্রস্তুত রয়েছেন।

খুলনার পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘটে যাওয়ায় বিভাগীয় এই শহর থেকেও আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। নতুন আইনের বিভিন্ন ধারায় সংশোধন দাবি করে সকল অপরাধে জামিনের বিধান রাখার দাবি তুলেছেন তারা।

খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম বেবি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আইন সংশোধন না করা পর্যন্ত শ্রমিকরা ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন।

রাজশাহী থেকে জেলার ভেতরের বিভিন্ন গন্তব্যে ও নওগাঁর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। জেলার পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, কিছু শ্রমিক ধর্মঘটে গেছেন। অনেকেই আবার ধর্মঘটে নেই। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

খুলনা : ঈগল পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের বাস সোমবার ভোরে খুলনা মহানগরীর রয়্যাল কাউন্টার থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। তবে ৯টার পর থেকে সব বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

সেখানকার শ্রমিক নেতারা বলছেন, দুর্ঘটনার মামলা জামিনযোগ্যসহ সড়ক আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন চান চালকরা।

আইন সংশোধনের পরই এটি কার্যকর করা হোক। এটা না করা পর্যন্ত আমাদের এ কর্মসূচি চলবে। তারা বলেন, সরকারের বিভিন্ন দফতরে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও আইনটি সংশোধন ছাড়াই বস্তবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। এতে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

এ কারণে খুলনায় সব রুটের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ২১ ও ২২ নভেম্বর শ্রমিক ফেডারেশন বর্ধিত সভা ডেকেছে। ওই সভার এজেন্ডাগুলোর মধ্যে এক নম্বরে আছে সড়ক পরিবহন আইন সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম বেবী বলেন, ‘কোনো কারণে দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে নতুন আইনে চালকদের মৃত্যুদণ্ড এবং আহত হলে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে। আমাদের এত টাকা দেয়ার সামর্থ্য নেই এবং বাস চালিয়ে আমরা জেলখানায় যেতে চাই না।’

খুলনা জেলা বাস-মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন সোনা বলেন, শ্রমিকরা ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দণ্ডের ভয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিচ্ছে। আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই তারা এসব করছে।

চুয়াডাঙ্গা : জেলা শহর থেকে অভ্যন্তরীণ বা দূরপাল্লার কোনো পরিবহন ছেড়ে যায়নি। যদিও শ্রমিক নেতারা বলছেন, তারা কোনো ধর্মঘটের ডাক দেননি।

এমনিতেই বিক্ষিপ্তভাবে শ্রমিকরা পরিবহন চালানো থেকে বিরত রয়েছেন। এদিকে ধর্মঘটের কারণে সাধার মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

হয়রানির শিকার হচ্ছেন জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াতকারীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষ শ্যালোইঞ্জিন চালিত অবৈধ পরিবহনে যাতায়াত করছে।

মেহেরপুর : মেহেরপুরের আন্তঃসড়কে ও দূরপাল্লার রুটে সোমবার সকাল থেকে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগ ও হয়রানির মধ্যে পড়েছেন যাত্রীরা।

মুজিবনগর উপজেলার যতারপুর গ্রামের প্রকৌশলী রয়েল শেখ ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশে মেহেরপুর থেকে ‘রয়েল পরিবহনে’ বেলা ৩টার টিকিট কিনেছিলেন।

দুপুর ২টায় তাকে জানানো হয় যাত্রীবাহী বাস ধর্মঘটের কথা। রয়েল শেখ জানান, পূর্ব ঘোষণা দিয়ে বাস ধর্মঘট হলে তিনি বিকল্প মাধ্যমে চাকরিস্থলে যেতে পারতেন।

মেহেরপুর জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক নজরুল ইসলাম জানান, সড়ক পরিবহনের নতুন আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার হবে না।

নড়াইল : জেলার ৮টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। চলছে না দূরপাল্লার বাসও। রোববার সন্ধ্যা থেকে এ জেলায় বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছাদেক আহম্মেদ খান জানান, বাস বন্ধ রাখার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

চালক-শ্রমিকরা নতুন পরিবহন আইনের ভয়ে বাস চালানো বন্ধ রেখেছেন।

কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) : কালীগঞ্জের সঙ্গে খুলনা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলায় বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। গন্তব্যে পৌঁছাতে যাত্রীরা মাহেন্দ্র, শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নসিমন বা ইজিবাইক ব্যবহার করছেন। এগুলো ভাড়া নিচ্ছে কয়েকগুণ।

উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) : উল্লাপাড়ার বিভিন্ন রুটে যানবাহন চলাচল একেবারে কম। এতে যাত্রীরা পড়েছেন ভোগান্তিতে। এ সুযোগে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণ। উল্লাপাড়া থেকে ঢাকার দূরপাল্লার বাসের ভাড়া সাড়ে ৩শ’ টাকা।

কিন্তু নেয়া হচ্ছে পাঁচশ’ টাকা। হাটিকুমরুল গোলচত্বর থেকে সিরাজগঞ্জের ভাড়া ১৫ টাকা। কিন্তু নেয়া হচ্ছে ৩০ টাকা।

শেরপুর : শেরপুর জেলা শহরের সঙ্গে ঢাকাসহ সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার ঘোষ এবং শেরপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান বলেন, বাস চালক-শ্রমিকরা নতুন পরিবহন আইনের ভয়ে স্বেচ্ছায় ঢাকাসহ সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন। এ ব্যাপারে সংগঠন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সাতক্ষীরা বাস টার্মিনাল থেকে গাড়ি না ছাড়ায় বিপাকে পড়েছেন যাত্রী সাধারণ। তারা বিকল্প যানবাহনে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেন।

জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ জানান, শ্রমিকরা নিজেরাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মালিক সমিতি এ বিষয়ে অবহিত নয়।

যশোর : যশোর অঞ্চলের ১৮ রুটে পরিবহন ধর্মঘট চলছে। রোববার দিনব্যাপী অচলাবস্থার পর রাতে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক নেতারা বৈঠকে বসেন। তারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের আশ্বাস দিলেও সোমবার তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। দূর-দূরান্তে যাতায়াতে সাধারণ মানুষের ভরসা এখন ট্রেন। যশোর রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীদের এখন উপচে পড়া ভিড়। যাত্রীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্টেশন কর্মকর্তারা।

যাত্রীর বলছেন, ‘সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না।’

যশোরের পুলিশ সুপার মঈনুল হক বলেন, রোববার রাতে বৈঠকে শ্রমিক নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন সোমবার পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে। কিন্তু এখানে শ্রমিক কিংবা বাস মালিক সংগঠন নয়, শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি পালন করছেন।

ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না শ্রমিক সংগঠনগুলো। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।

বেনাপোল : বাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকায় সোমবার বেনাপোল বন্দর থেকে কোনো মালামাল লোড-আনলোড ও খালাস হয়নি। ফলে শত শত খালি ট্রাক পণ্য লোড করার জন্য বন্দরের সামনে অবস্থান করছে।

বেনাপোল-যশোর ও যশোর-সাতক্ষীরার অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীবাহী বাস চলাচল না করলেও কার, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, মাহেন্দ্র, নসিমন-করিমন জাতীয় ছোট যানবাহন এবং অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচল করছে।

রাজশাহী : রাজশাহীর সঙ্গে বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকরা। সোমবার সকালে নগরীর শিরোইল ও নওদাপাড়া বাস টার্মিনালের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা।

জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, এটা ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ডাকা কোনো ধর্মঘট নয়। নতুন সড়ক আইনের ভয়ে শ্রমিকরা নিজেরাই বাস বন্ধ রেখেছেন।

সিলেট : সিলেট-গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ সড়কে বিআরটিসি বাস চলাচল বন্ধের দাবিতে বাস ধর্মঘট শুরু হয়েছে। সোমবার সকাল ৬টা থেকে কোম্পানীগঞ্জ-গোয়াইনঘাট-হাদারপাড় বাস-মিনিবাস সমিতির ডাকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট চলছে।

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে বলে জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি রিমাদ আহমদ রুবেল।