সৌদি আরবে গৃহস্থালীর কাজে বাংলাদেশি নারী কর্মীদের পাঠানো বন্ধের চিন্তা আপাতত সরকার করছে না বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। সৌদি থেকে ৫৩ নারীর মৃতদেহ ফিরেছে, যা খুবই নগণ্য বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমিরাত সফর উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গতকাল মন্ত্রী বলেন, সৌদি আরবে বর্তমানে ২ লাখ ৭০ হাজার নারী কর্মী কাজ করছেন। এর মধ্যে সাড়ে ৮ হাজারের মত নারী কর্মী দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে ফিরে এসেছেন।
একমাত্র নির্যাতনই এদের সবার ফেরার কারণ নয়। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তথ্যের উদৃতি দিয়ে মন্ত্রী বলেন, যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে কতজন নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন তা নিশ্চিত নয়। মন্ত্রী বলেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। কিন্তু এ অবস্থায় কর্মী পাঠানো বন্ধ করা কোন সমাধান নয়।
নারী কর্মী পাঠানো বন্ধের দাবি তোলা ব্যক্তি ও সংগঠনের সমালোচনা করে মন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করেন- সৌদিতে যারা গেছেন তাদের সবার কর্মসংস্থান দেশে নিশ্চিত করা কী সম্ভব? তিনিই ফের জবাব দিয়ে বলেন, নিশ্চয়ই না। তাহলে আমরা বন্ধ করবো কেন? সরকার নারীদের প্রতি কোন বৈষম্য করতে চায় না জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশেও গৃহস্থালীর কাজ করা নারীরা নানা কারণে বঞ্চনার শিকান হন। সৌদিতেও তা-ই। দেশটিতে নারী কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় অনেক ত্রুটি আছে স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, অভিযোগ আসার প্রেক্ষিতে সরকার সেই ত্রুটি দূর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে এখন থেকে গৃহস্থালীর কাজে যাওয়া নারী কর্মীদের পাঠানোর আগে তারা কার বাড়িতে কাজ করতে যাচ্ছেন তার বিস্তারিত জানিয়ে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতদিন তা ছিল না। তিনি বলেন, আমরা জানতামই না কে কোথায় যাচ্ছেন। এখন সেটা হবে।
মন্ত্রী দাবি করেন, যেসব নারী কর্মী দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে ফিরছেন তারা কেউই উদ্ধার হওয়ার পর নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ করেননি। দেশে এসে যারা নির্যাতনের বর্ননা দেন তাদের নানাজন নানা কারণে অভিযোগ করেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, যদি সংখ্যা দেখেন তাহলে খুবই ছোট একটা সংখ্যা। ৯০ শতাংশ নারী ম্যানেজ করে নিয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, তারা নিয়মিত দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। অনেকে আন্দোলন করছেন নারীদের যাওয়া বন্ধ করে দেয়ার। আমি জানি না, নারীরা এটাকে কীভাবে দেখবেন। তাদের কাজের জায়গা কমিয়ে দিচ্ছেন, যারা (এনজিও) দাবি করছেন তাদের চাকরি দেবেন না বিদেশে। তারা কি চাকরি দেবেন ওইসব নারীদের? দেশে থাকলে কি ভালো চাকরি হবে তাদের, এমন প্রশ্নও রাখেন মন্ত্রী। বিদেশে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, দেশে বিকাশমান অর্থনীতিতে পুরুষের পাশাপাশি অবদান রেখে চলেছেন বিপুল সংখ্যক নারী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের তালিকায় নারীর অন্তর্ভুক্তি নিঃন্দেহে সুখকর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬ লাখ নারী শ্রমিক কর্মরত আছেন। অসুবিধা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে যান না বলে অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন। কিছু কিছু নারী নিজেদের কারণে নির্যাতিত হন। প্রথমে যাওয়ার পর তারা ভাষাগত সমস্যায় পড়েন। মালিক উনাকে যে আদেশ করেন উনি (ওই নারী) বুঝতে পারেন না। আর চাহিদা মতো রান্না করতে না পারায় নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এ ধরনের বহু রকমের সমস্যা আছে। ঋণ করে কিংবা জমাজমা বিক্রি করে নির্ধারিত সময়ের আগে দেশে ফিরলে তাদের ক্ষোভ-দুঃখ হয়। এ কারণেও অনেকে নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন বলেও মন্তব্য করেন মন্ত্রী। উল্লেখ্য, রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস আগেই ঢাকাকে জানিয়েছে, দূতাবাসের মাধ্যমে সাড়ে ৮ হাজার নারী কর্মী ফিরলেও এ হিসাবের বাইরে আরও প্রায় ১১ হাজারের মত বাংলাদেশি নারী সৌদি আরব থেকে নিজ উদ্যোগে দেশে ফিরেছেন। কফিলের নির্যাতনই এর একমাত্র কারণ নয়। ভাষা না বুঝা, খাওয়া দাওয়াসহ সৌদি আরবে কাজের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা, একান্ত ব্যক্তিগত, পরিবারিক এবং সামাজিক বাস্তবতাসহ নানা কারণে প্রায় ২০ শতাংশ নারী কর্মী নির্ধারিত সময়ের আগেই দেশে ফিরেছেন বলে জানিয়েছে সৌদি আরবের বাংলাদেশ মিশন। রিপোর্টে এ-ও বলা হয়েছে- সংখ্যা যাই হোক নির্যাতনের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, এ অবস্থায় নারীদের সুরক্ষার গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা ছাড়া দেশটিতে নতুন করে আর কাউকে না পাঠানোর। এ নিয়ে জাতীয় সংসদেও কথা হয়েছে। বিরোধী সংসদ সদস্যরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীকে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এমপিরা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত অন্তত নারী কর্মীদের পাঠানো বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। বিরোধী জাতীয় পার্টি ও গণফোরামের সংসদ সদস্যরা দাবি করেছেন যে, গৃহস্থালি কাজের জন্য সৌদি আরবে যেয়ে প্রায়শই শারীরিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়ে ফিরছেন তারা। জবাবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে সরকার খুবই চিন্তিত। তিনি সংসদকে জানান, বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশিক্ষণের পর নারী কর্মীদের প্রেরণের পদক্ষেপ নেয়া হবে। যদি মনে হয় যে- এটি পুরোপুরি অসম্ভব, তবে নারী কর্মীকে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা বন্ধের চিন্তা করছি না। নানা বিকল্প নিয়ে ভাবছি।