রাজধানীতে অপরাধ জগতের আরেক গডফাদার যুবলীগ নেতা মাইনুল হোসেন খান নিখিল। এমন কোন অপরাধ নেই যার সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের এই সভাপতি জড়িত নন। চলমান ক্যাসিনো-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিবিরোধী অভিযানে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর সাম্রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হানা দিলেও নির্বিঘ্নে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছেন উত্তরের যুবরাজখ্যাত মাইনুল হোসেন খান নিখিল। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ভূমিদখল, স্পা ব্যবসা, ক্যাসিনো ব্যবসা ও সরকারি জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অবৈধ ব্যবসা থেকে আয় করা টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে তার অবৈধ সম্পদের তথ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে অভিযোগ পড়েছে। দুদক এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এই যুবলীগ নেতা।

দুদকে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গাঢাকা দেয়ার পর রাজধানীর অপরাধজগত নিয়ন্ত্রণ করছেন উত্তরের সভাপতি মাইনুল হোসেন খান নিখিল। তার নিজস্ব বাহিনীই মহানগরীর ফুটপাথে চাঁদাবাজি-মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। এছাড়া টাকার বিনিময়ে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের শেল্টার দেয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা কমিটির পদ পেতে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছে। ফলে পদবঞ্চিত হতে হয়েছে প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের। টাকার বিনিময়ে জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মী এখন যুবলীগের বিভিন্ন পদ বাগিয়ে নিয়েছেন।

মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় সরকারি জায়গা দখল করে একটি মার্কেট নির্মাণ করেছেন যুবলীগের এই সভাপতি। সেখানে প্রতিটি দোকান থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা অগ্রিম নেয়া হয়েছে। প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা ভাড়া তুলে নিজের পকেট ভারি করছেন। এছাড়া পল্লবীর মল্লিকা হাউজিং এলাকায় জাল কাগজপত্র দিয়ে দুটি প্লট দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি। মিরপুর এলাকার অধিকাংশ গার্মেন্টস থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হয় তাকে। এছাড়া ফুটপাথের চাঁদা তুলে তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। চাঁদা না দিলেই সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ২৯৬ দক্ষিণ মনিপুর, ৫৫৩ মাইকওয়ালা মসজিদ, ৮৮৮, মধ্য মনিপুর মোল্লা রোড, ১২৬৭/৩, পূর্ব মনিপুর বালির মাঠ, ১৯৩/৩, সেনপাড়া, ১৩, বাউন্ডারি রোড, সেকশন-৬ পশ্চিম সেনপাড়ার বাসাগুলো দখলের অভিযোগ রয়েছে। বাইশবাড়ি এলাকার সব বাড়ির কাজ ও মসজিদ পর্যন্ত পানির লাইনের কাজ করতে হলে তাকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। মোল্লা রোড এলাকায় তার পক্ষে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগ নেতা আহাদ মোল্লা ও সাগর মোল্লা। খেজুরতলা থেকে বাইশবাড়ি পর্যন্ত মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন শাহজাহান, কামরুল, নূর হোসেন, সামসূল হক শাওন ও তার ভাই বাদ্দু। মোল্লাপাড়া থেকে ৬০ ফিট মাইকওয়ালা মসজিদ পর্যন্ত মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক নিখিলের ভাগিনা মাহবুব ও গফুর মোল্লা। এছাড়া পুরো দক্ষিণ মনিপুর, পূর্ব মনিপুর, পশ্চিম মনিপুর, মধ্য মনিপুরসহ পুরো মিরপুর এলাকায় চাঁদাবাজি ও অসামাজিক কাজ নিন্ত্রয়ণ করে নিখিলের ছোট ভাই ওপেল, ভাগিনা হিমেল, মাজু মোল্লা, মাহবুব, শাহজাহান, কামরুল, হানিফ, আহদা মোল্লা, মিঠু, সবুজসহ নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। মহাখালীর কড়াইল বস্তি, মিরপুরের একাধিক বস্তিতে অবৈধ গ্যাস ও পানির লাইন সংযোগের সঙ্গে তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদকে করা অভিযোগে আরো বলা হয়েছে অত্যন্ত ধুর্ত প্রকৃতির এই লোক অবৈধ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন। একদিনেই ১০ লাখ ইউরো বিদেশে পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। বেলজিয়ামে রয়েছে তার একটি অত্যাধুনিক পেট্রল পাম্প। এছাড়া তার একাধিক বাড়িও রয়েছে বিভিন্ন দেশে। মিরপুরের এক আতঙ্কের নাম মাইনুল হোসেন খান নিখিল। তার ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পান না।

এবিষয়ে নিখিলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মিথ্যা অভিযোগে তাকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। তার কোন অবৈধ সম্পদ নেই। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের মার্কেটটি তার নয়। তিনি সেখানে কয়েকটি দোকান কিনেছেন। এছাড়া পল্লবীর মল্লিকা হাউজিংয়ে তার কোন বাড়ি নেই, তিনি সেখানে দুটি বাড়ি ডেভেলপ করেছেন। জামায়াত-শিবিরের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার বাড়ি জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর বাড়ির পাশে। তাদের তিনি কোন ধরনের সহযোগিতা করেননি। বেলজিয়ামে পেট্রল পাম্প সম্পর্কে তিনি বলেন, সেখানে আমার ভাইয়ের নামে একটি বাড়ি আছে। আমার ভাই সেখানে ব্যবসা করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তান সেখানে থাকেন। পেট্রল পাম্প থাকার তথ্যটি সঠিক নয়।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর থেকেই আলোচনায় আসে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার নাম। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশের চারদিনের মাথায় ১৮ সেপ্টেম্বর সম্রাট-খালেদ নিয়ন্ত্রিত ক্যাসিনোগুলোতে অভিযান শুরু করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ওইদিনই গুলশানের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় খালেদকে। খালেদকে গ্রেফতারের খবর পেয়েই আতঙ্কে কয়েকশ’ নেতাকর্মী নিয়ে কাকরাইলের রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের বিপরীতে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান নেন সম্রাট। সেখানে কয়েক দিন থাকেন তিনি। প্রতিদিনই সেখানে শত শত নেতাকর্মী তাকে পাহারা দিয়ে রাখেন। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে তুমুল আলোচনা চলতে থাকে শেষ পর্যন্ত সম্রাটকে গ্রেফতার করা হবে কিনা। কয়েক দিনের মাথায় কার্যালয় থেকে সটকে পড়েন সম্রাট। অনেকটা আত্মগোপনে চলে যান তিনি। পরে কুমিল্লা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
উৎস -সংবাদ