এয়ারপোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে খ্যাতি অর্জন করা দুদক পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফের স্ত্রী তানিয়া ইসরাত গতকাল বৃহস্পতিবার মারা গেছেন। বুধবার সন্ধ্যা ৭টার পর অগ্নিদগ্ধের ঘটনা ঘটলে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে সেখান থেকে রাজধানীর সিএমএইচে নেওয়া হয়। সেখানেই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন লেখক শরিফুল হাসান। কালের কণ্ঠের পাঠকদের জন্য তাঁর লেখাটি প্রকাশিত হলো-

‘তখন সন্ধ্যা সাতটা। বনানী কবরস্থানের সামনে বিষন্নমনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা কিছু মানুষ। বাইরের বৃষ্টি থেমেছে। ম‌নের বৃ‌ষ্টি থা‌মে‌নি। ইউসুফ ভাই যখন তাঁর পুত্রকন্যাকে নিয়ে এলেন ম‌নে হ‌লো, ফের বৃ‌ষ্টি শুরু হ‌লো। কে তখন কার কান্না থামাবে? বাবাকে জড়িয়ে ধরে কিশোর ছেলেমেয়ে দুটো কাঁদছে। বাবাও দুজনকে জড়িয়ে কাঁদছে। কাঁদছি আমরা সবাই।

ভাবীর জানাজা যখন শুরু হ‌লো তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। জানাজায় দাঁড়ি‌য়েও আমি শুধু ভাবছিলাম ছেলেমেয়ে দুটোর কথা। তাদের মানসিক অবস্থার কথা। ভাব‌ছিলাম বাবা আর ছেলে মিলে দরজা ভেঙে ভাবীকে বের করছে। সা‌দের চোখের সামনে মায়ের দগ্ধ শরীর। এরপর হাসপাতাল! মৃত্যু। দাফন! আমি জানি না এই ট্রমা কাটবে কী করে।

এর মধ্যেই আবার যখন দেখি একদল ফেসবুকবাসীর নানা কথা, কষ্টটা আরও বেড়ে যায়। আচ্ছা আপনারা যারা ফেসবুকে নানা মানুষকে চেনেন, কতোটা জানেন তাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে? আমি কোনদিন আমার পারিবারিক কোনো বিষয়ে পোস্ট দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। ইউসুফ ভাইও কী কখনো ভাবীকে নিয়ে কোন পোস্ট দি‌য়ে‌ছিল? আপনা‌দের তো জানার কথা নয়, এর আগেও অনেকবার ভাবী আত্মহত্যার চেষ্টা ক‌রে‌ছে। জান‌বেন কী ক‌রে? আমরা যে সয‌ত্নে নি‌জে‌দের কষ্টগু‌লো আড়াল ক‌রে রা‌খি। আজ আপনাদের কিছু মানুষের কথা শুনে মনে হচ্ছে ভাবীর মানসিক দুরবস্থার কথা, আগের একাধিকবারের আত্মহত্যার চেষ্টার কথা আপনাদের জানিয়ে রাখা উচিত ছিল।

হ্যাঁ, আপনাদের মতো আমিও ইউসুফ ভাইকে ফেসবুকের সূত্রেই চিনি। কিন্তু যে কোনো সৎ মানুষের সাথে ফেসবু‌কের বাইরে বাস্ত‌বে মেশার চেষ্টাটাও আমার থাকে। আর ইউসুফ ভাই যেহেতু এয়ারপোর্টে ছিলেন সেই সূত্রে ‌বে‌শি মেশা। ম‌নে আছে, ক‌তো‌দিন এয়ার‌পো‌র্টে কা‌জে বা বাইরে যাওয়ার সময় দেশ, মানুষ নি‌য়ে ক‌তো কথা ব‌লে‌ছি। কিন্তু ভাবীর অসুস্থতার খবরটা জানতাম না। এই রোজার মাসে রক্ত চাওয়ার স্ট্যাটাস দেখে জানতে পারি ভাবী অসুস্থ। এরপর যোগা‌যোগ করলাম।

হ্যাঁ, রোজার মাসে উত্তরা গি‌য়ে‌ছিলাম। রক্ত দি‌য়ে‌ছিলাম ভাবী‌কে। এরপর আমি, ইউসুফ ভাই, ভাবীসহ সবাই মিলে ইফতার করলাম। দীর্ঘ সময় গল্প! ক‌তো ক‌তো গল্প। কথায় গল্পে বুঝলাম ভাবীসহ পরিবারের সবাইকে কতোটা আগলে রাখেন ইউসুফ ভাই। ভাবী সবসময় বিশ্বাস করতেন, যে কোন সংকটে রূপকথার গল্পের মতো হাজির হবেন ভাই। অতী‌তেও তাই হ‌য়ে‌ছিল। আজও আগুনে দগ্ধ ইউসুফ ভাইয়ের হাত দেখে মনে হচ্ছিল ভাবী‌কে বাঁচা‌নোর চেষ্টা কর‌তে গি‌য়ে দগ্ধ অবস্থাতেই জড়িয়ে ধরেছিলেন ভাই। দগ্ধ সেই হা‌তে হাত রাখতেই ভাই বলছিলেন, কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি না তানিয়া নেই।

আমি জা‌নি না কী ক‌রে কান্না থামা‌তে হয়! আমার পু‌রো শরীর তখন রাজ্যের ক্লান্তি। যেন নি‌জেই ভে‌ঙে পড়‌ব আরেকজন‌কে স্বান্ত্বনা দি‌তে গি‌য়ে। কারণ, সেই ভোরবেলা সুইজারল্যান্ডের স্টেট সেক্রেটারি ফর মাইগ্রেশন আর সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতসহ বিশাল একটি টিমের সা‌থে গি‌য়ে‌ছিলাম নরসিংদী। সেখা‌নেই সকাল ১০টার দিকে হঠাৎ ফোন এলো হাতিয়া থেকে। ভাবীর এক আত্মীয়ের সূত্রেই জানতে পারলাম আগুনে দগ্ধ হয়ে তানিয়া ভাবী মারা গেছে। আমার তখন অস্থির লাগ‌ছে। কিছু‌তেই মন শান্ত হ‌চ্ছে না।

বারবার ভাবছিলাম কয়েকমাস আগে যে মানুষটাকে রক্ত দিলাম, আমার রক্তে যে মানুষটা সুস্থ হয়ে উঠছিলেন সেই মানুষটা আজ নেই! ভাব‌তে ভাব‌তেই নরসিংদীর কাজ শেষ করে সরাসরি হাজির হলাম বনানীতে। বাবা, ছে‌লে, স্বজন‌দের কান্নায় কী করে যে চোখের পানি আটকে রাখি! ভাবীর লাশটা যখন নামালাম এতো ভারী লাগছিলো! আর জানাজা শেষে লাশ নেয়ার সময় কফিনে আমার সাথেই যখন কিশোর সাদ ক‌ফি‌নে হাত দি‌লো আমার বুক ভে‌ঙে যা‌চ্ছিল।

আমার ম‌নে হ‌চ্ছিল, সাদ যেন ক‌ফিন নয়, মাকে স্পর্শ করতে চাইছে। মনে পড়লো ১১ বছর আগেও আমি এভা‌বে মায়ের কফিন স্পর্শ করে রেখেছিলাম সারাটা পথ। দাফন শেষ হ‌লো। রাতে বাসায় ফিরলাম। বনানী কবরস্থানের সাম‌নে আমি আর মাহকুব কবীর মিলন ভাই বারবার, বলছিলাম আল্লাহ ভালো মানুষগুলোকেই কেন বারবার পরীক্ষায় ফেলেন। কেন ভা‌লো মানুষ‌দের জীব‌নে এতো কষ্ট আসে!

আমি জা‌নি না এই প্র‌শ্নের উত্তর। দোয়া ক‌রি, আল্লাহ ভাবী‌কে জান্নাতবাসী করুন। আর সব‌কিছু সামলা‌নোর শ‌ক্তি দিক ভাইকে। আমি জানি না ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে ইউসুফ ভাই কীভা‌বে সব সামলাবে! শুধু দোয়া ক‌রি আপনা‌দের জন্য। আল্লাহ আপনা‌দের শ‌ক্তি দিক। বাবা, ছে‌লে, মে‌য়ে পরস্পর‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রি‌য়ে শোক সামলান আপনারা! সবাইকেই তো এক‌দিন চ‌লে যে‌তে হ‌বে। শুধু মৃত্যুগ‌ু‌লো য‌দি এমন কষ্টের না হ‌তো! শোকগু‌লো এতো বেদনার না হ‌তো!’

(লেখক ও মানবাধিকারকর্মী শরিফুল হাসানের ফেসবুক পোস্ট থেকে) সূত্র-কালের কন্ঠ