ভারতের আসামে একজন ব্যক্তিকেও রাষ্ট্রহীন না করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। আসামে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ লাখ মানুষ বাদ পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এ আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন।

অন্যদিকে তালিকায় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে স্বল্পসংখ্যক মুসলিম বাদ পড়ায় পুরো এনআরসি প্রক্রিয়াটিকেই ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে নতুন সমীক্ষার দাবি জানিয়েছে বিজেপি। বিপরীতে বাদ পড়াদের বেশির ভাগই হিন্দু হওয়ায় বিরোধীদের তোপের মুখে পড়েছেন কেন্দ্রে ও আসাম রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও দলটির নেতারা।

গতকাল রোববার জেনেভায় জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) এক বিবৃতিতে একজনও যেন রাষ্ট্রহীন না হয়ে পড়ে, তা নিশ্চিত করতে বলেছে ভারতকে। বিবৃতিতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রানদি ১৯ লাখ লোক বাদ পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, কোনো প্রক্রিয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ যখন জাতীয়তাহীন হয়ে পড়ে, তখন তা হবে বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রহীনতা নির্মূল করার প্রক্রিয়ার ওপর বিশাল আঘাত।
অন্যদিকে এনআরসিকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে যে কৌশল নিয়েছিল বিজেপি, তা বুমেরাং হওয়ায় রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে বিজেপি। আসামের বাংলা দৈনিক যুগশঙ্খ স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে গতকাল পত্রিকাটির গুয়াহাটির প্রিন্ট সংস্করণের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাদ পড়া ১৯ লাখের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ লাখই হতে পারে হিন্দু বাঙালি। এ তথ্যেই এনআরসি প্রক্রিয়ার ওপর বেজায় খেপেছে রাজ্য বিজেপি।

বিজেপির প্রত্যাশা ছিল নাগরিক তালিকা থেকে মুসলিমদের বড় একটি অংশ বাদ পড়বে। এখন উল্টো ফল হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত রাজ্য এনআরসি সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলার ওপর তোপ দাগাচ্ছেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির নেতারা। আসাম বিজেপির সভাপতি রণজিৎ কুমার দাস শনিবার রাতে পিটিআইকে বলেছেন, ‘আমরা এই এনআরসিতে আর আস্থা রাখছি না। ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে অনেক মানুষ তালিকায় ঢুকে গেছে। অথচ দুই লাখ ‘প্রকৃত ভারতীয়’ বা ভূমিপুত্র তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন আমরা যদি দেখি ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে’ খারাপ ফল এসেছে, তাহলে আমরা বিষয়টি পার্লামেন্টে তুলব এবং তাদের রক্ষা করার জন্য আইন প্রণয়ন করব।

মূলত মুসলিম অভিবাসী অধ্যুষিত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সামান্য হারে বাদ পড়ার বিষয়টিকেই এনআরসির ত্রুটি হিসেবে তুলে ধরতে চাচ্ছে বিজেপি।
রাজ্য বিজেপি নেতা ও অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা গতকাল টুইটারে এক পোস্টে বলেন, ১৯৭১ সালের আগে বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক ব্যক্তি ‘শরণার্থী সার্টিফিকেট দাখিল করেও তালিকায় ঢুকতে পারেনি। অথচ পরে এসেও অনেকে উত্তরাধিকার তথ্য দাখিল করে তালিকায় ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ২০ শতাংশ এবং অন্য জেলাগুলোতে ১০ শতাংশ হারে তালিকা পর্যালোচনা বিষয় সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন করা উচিত।

বিজেপির সঙ্গে সুর মিলিয়েছে অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (আসু) ও আসাম পাবলিক ওয়ার্ক (এপিডাব্লিউ), যাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই এনআরসি তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। তারা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, এত কম সংখ্যায় বাদ পড়ায় তারা সন্তুষ্ট নয় এবং তারা এর পর্যালোচনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবে। এপিডাব্লিউ শতভাগ নতুন এনআরসির দাবি জানিয়েছে।

শক্ত অবস্থানে এনআরসি কর্মকর্তা : আসামে এনআরসি প্রধান কর্মকর্তা তথা এনআরসির আসাম রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা বলেছেন, ৫২ হাজার সরকারি কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রণীত এই এনআরসি হালনাগাদ করা ছিল একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। তালিকা রাখা ও না রাখার সব সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে বিধিবদ্ধ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে।

বাদ পড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যরাও : শনিবার আসামের চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশের পর তালিকায় নাম পাওয়া যায়নি ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদের পরিবারের কয়েকজন সদস্যের নাম। ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ ভারতের পঞ্চম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনকালে মৃত্যুবরণ করা দ্বিতীয় ভারতীয় রাষ্ট্রপতি তিনি। আসামের দৈনিক পত্রিকা ‘প্রান্তজ্যোতি’ এ তথ্য জানিয়েছে।
বিরোধীদের তোপের মুখে বিজেপি নেতারা : আসামের পত্রিকা যুগশঙ্খ পত্রিকার অনলাইন সংস্কারে গতকাল এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনিবার এ তালিকা প্রকাশ হতেই কেন্দ্র ও রাজ্য বিজেপিকে একহাত নিয়েছেন আসামের বিধায়ক আব্দুল খালেক। এনআরসি ইস্যুতে বিজেপি নেতা ও আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশকে অপমান করেছেন বলে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেন তিনি। তিনি হিমন্ত বিশ্বশর্ম ও বিজেপির আরেক নেতা শিলাদিত্য দেবকে পরিবেশদূষণকারী হিসেবেও কটাক্ষ করেছেন। পাশাপাশি তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন, ভারতের মাটিতে আশ্রিত বাংলাদেশিরা এ দেশেই থাকবে।

এ দিকে এনআরসির ত্রুটি নিয়ে তোপ দেগেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদসহ অন্যান্য বাহিনীর জোয়ান এবং এক লাখ গোর্কা জনগোষ্ঠীর সদস্য বাদ পড়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি ফের কোনো ভারতীয় যাতে বাদ না পড়ে, এ জন্য সরকারকে হুঁশিয়ার করে দেন। এক টুইটে মমতা বলেন, রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চেয়েছিল তারা। এবার তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে এনআরসি।

১৫ লাখ ‘বাংলাদেশিকে’ ফেরত আনতে বলবে আসাম : অন্যদিকে ভারতের নিউজ ১৮ কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আসামের অর্থমন্ত্রী ও রাজ্য বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্ম দাবি করেছেন, আনাসে নাগরিক তালিকার পর ১৪ লাখ লোককে বিদেশি হিসেবে শনাক্ত করেছে। তাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশকে বলা হবে।

হিমন্ত বলেন, ‘আমরা ১৪-১৫ লাখ বিদেশি শনাক্ত করেছি।…এটা প্রমাণিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা আমলে নিচ্ছি না। কারণ অবৈধ বিদেশিরাই তাঁর ভোট ব্যাংক।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু। তারা আমাদের সহযোগিতা করে আসছে। অবৈধ অভিবাসনের ক্ষেত্রে তারা তাদের নাগরিকদের নিয়মিতই ফেরত নেয়। এ সংখ্যা কখনো খুব বেশি ছিল না। কিন্তু এখন তাদের চিহ্নিত করতে একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে তালিকায় কারও নাম না থাকলেই সে বিদেশি এবং তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে, তা নয়। সূত্র : এএফপি, দৈনিক প্রান্তজ্যোতি, যুগশঙ্খ ও আনন্দবাজার।